শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মানে কাজ করছে জ্ঞান বিজয় সেবাশ্রম

স্টাফ রিপোর্টার

আপডেট : ০৬:৩৮ পিএম, শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২১ | ৭৭২

শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মান, শিক্ষা বিস্তার ও হতদরিদ্রদের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে কাজ করছে বাগেরহাটের জ্ঞান বিজয় সেবাশ্রম। শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে উচু-নিচু শ্রেণির ধারণাকে পাল্টে দিতে প্রগতিশীল মানুষদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে সাধু সমাজ। যেখানে সবাই পরিচিত হবেন মানুষ হিসেবে, থাকবেনা কোন বৈষম্য। মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রনোদনা, অসহায়দের আর্থিক ও খাদ্য সহযোগিতা, স্বজনহারাদের থাকার ব্যবস্থা, কৃষকদের উপকরণ সহায়তাসহ নানা উন্নয়ন মূলক কাজে স্থানীয়দের প্রসংশা কুড়িয়েছে বাগেরহাট সদর উপজেলার হালিশহর গ্রামের এই প্রতিষ্ঠানটি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার বছর বিশেক পূর্বে মানুষের সেবা করা শুরু করেন বাখোরগঞ্জ গ্রামের বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী। প্রতিষ্ঠা করেন শ্রী হরি মন্দির। ভক্ত ও অনুরাগীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। হাজার হাজার ভক্ত দর্শনার্থীরা আসতে থাকেন বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামীর প্রতিষ্ঠিত হরিসভা মন্দিরে। প্রতিবছরই আয়োজন করা হত ধর্মীয় মহোৎসব। স্থানীয় লোকজন ধর্মীয় আধ্মাতিক গুরু ও মতুয়া হিসেবে জানতেন বিয়জ কৃষ্ণ গোস্বামী। স্ত্রী জ্ঞান দা দেবীকে নিয়ে মতুয়া সম্প্রদায়ের রীতিনীতি মেনে চলতেন। নিজের ভক্ত ও ভৃত্যদের মাঝে জ্ঞান বিতরণ করে যেতেন। তবে এসব কিছুই চলত অনানুষ্ঠানিকভাবে। এরই মাঝে ২০০১ সালে বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী মারা যান।

পরে ২০১০ সালে মারা যান আধ্মাতিক গুরু বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামীর স্ত্রী বিশিষ্ট মতুয়া জ্ঞান দা দেবী। বাবা-মা মারা যাওয়ার পরে মানব সেবা ও ভক্তদের দায়িত্ব পরে জ্ঞান-বিজয় দম্পত্তির ছেলে আনন্দ মোহন বিশ্বাসের উপর। তিনিও ধর্মীয় রীতিনীতি অনুযায়ী মানুষের সেবা করা শুরু করেন।তবে মানব সেবা করতে গিয়েও নানা অপ-সংস্কৃতি ও রীতিনীতির ফাঁদে পরে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয় আনন্দ মোহন বিশ্বাসকে। সবকিছু উপেক্ষা করে ২০১৭ সালে মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগিয়ে তোলার জন্য পিতার নামে গড়ে তোলেন জ্ঞান বিজয় সেবাশ্রম নামের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান।শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মানের জন্য তৈরি করেন সাধু সমাজ নামের একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। হিন্দু ধর্মালম্বী যেকোন মানুষ চাইলেই এই সাধু সমাজের সদস্য হতে পারেন। সাধু সমাজের সদস্য সংখ্যা এখন প্রায় ২ হাজারের উপরে। সাধু সমাজের সদস্যরা হিন্দু ধর্মীয় যে শ্রেণি বৈষম্য রয়েছে দূর করার জন্য আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছেন।সাধু সমাজের সদস্যদের এগিয়ে নিতে কাজ করছেন জ্ঞান বিজয় সেবাশ্রম।

প্রায় চার বছরের আনুষ্ঠানিক যাত্রায় জ্ঞান বিজয় সেবাশ্রম প্রতিবছর ২ শতাধিক মেধামী শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন পরীক্ষার ফরম ফিলআপের টাকা দিয়ে আসছেন। হালিশহর ও আসপাশের কয়েকটি গ্রাম থেকে প্রতিবছর মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপ বিতরণ ও আর্থিক সহযোগিতা করে থাকেন।কারিতাষ নামক একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় ঝড়েপড়া শিক্ষার্থীদের জন্য জ্ঞান বিজয় সেবাশ্রমের পরিচালনায় রয়েছে কারিগরি প্রশিক্ষন কেন্দ্র। যেখান থেকে স্থানীয়দেরঅটো মোবাইল সার্ভিসিং, সেলাই মেশিনসহ বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষন করার সুযোগ রয়েছে। হত দরিদ্র কৃষকদের উপকরণ সহযোগিতাও করা হয় জ্ঞান বিজয় সেবাশ্রমের পক্ষ থেকে। হতদরিদ্র ও সন্তান হারা মায়েদের বিনামূল্যে থাকা ও খাওয়ার জন্য রয়েছে জ্ঞান মন্দির নামের একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান। যেখানে অন্তত ২০ থেকে ২৫ জন অসহায় মানুষের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।জ্ঞান বিজয় সেবাশ্রমের এই কার্যক্রমকে সাধুবাধ জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়রা।

স্থানীয় নারী ইউপি সদস্য সোভা রানী মন্ডল বলেন, জ্ঞান বিজয় সেবাশ্রম একটি জনকলান মুখী প্রতিষ্ঠান। যেকোন অসহায় মানুষকে এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের উপকার করে এই প্রতিষ্ঠানের মালিক আনন্দ মোহন বিশ্বাস।

স্থানীয় গোপাল রায়, পিনাক মন্ডল, চিত্ত রঞ্জন মজুমদারসহ কয়েকজন বলেন, জ্ঞান বিজয় সেবাশ্রম শুধু ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের মধ্যে আবধ্য নয়। এই প্রতিষ্ঠান এলাকার হতদরিদ্রদের সহযোগিতা ও শ্রেনি বৈষম্য নিরসনে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা এই প্রতিষ্ঠানের মঙ্গল চাই।

ঠাকুর দাস মন্ডল বলেন, আমি সাধু সমাজের একজন সদস্য। আমরা সাম্যের সম্মানে বিশ্বাস করি। ব্রা²ন, ক্ষত্রিয়, বৈষ্ণ ও সুদ্র এই চার শ্রেণির বেড়াজালে হায়ার কাস্ট (উচ্চ বর্ণ), মিডিল কাস্ট (মধ্য বর্ণ), শিডিউল কাস্ট, লোয়ার কাস্ট(নিম্ন বর্ণ)হিসেবে মানুষকে বিবেচনা করা হয়। নানা সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হন তারা।

জ্ঞান বিজয় সেবাশ্রমের সভাপতি আনন্দ মোহন বিশ্বাস বলেন, আমরা সবাই একই গ্রষ্ঠার সৃষ্টি। আমরা গ্রষ্ঠার সৃষ্টিকে ভালবাসি।মানুষের সেবা করাই আমাদের মূল লক্ষ। শিক্ষা বিস্তারে হতদরিদ্র মেধাবীদের আর্থিক সহযোগিতা, কৃষকদের চাষাবাদসহ প্রত্যেকটি কাজে সহযোগিতা করে থাকি। স্বজন হারা অসহায় মায়েদের জন্য রয়েছে আমাদের জ্ঞান মন্দির।

আনন্দ মোহন বিশ্বাস আরও বলেন, মানুষ হিসেবে সবাই সমান। সবাই-ই রাষ্ট্রের নাগরিক। প্রত্যেকের সমান সুযোগ পাওয়া উচিত। কিন্তু শুধুমাত্র ধর্মীয় রীতিনীতির অজুহাত দিয়ে মানুষকে পিছিয়ে রাখা যাবে না। আমরা সাধু সমাজের মাধ্যমে সেই শ্রেণিবৈষম্য দূর করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমরা ধর্মে বিশ্বাস করি। কিন্তু ধর্মের নামে কোন মানুষের অধিকার হরণের রীতি মানি না। মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে আমরা সকল মানুষকে সাম্যের সম্মান এনে দেওয়া দাবি জানান তিনি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত