সন্দেহ বাতিক ও আমাদের যাপিত জীবন

আপডেট : ০৫:০৮ পিএম, মঙ্গলবার, ২৭ এপ্রিল ২০২১ | ৭২৩

সন্দেহ বাতিক ও আমাদের যাপিত জীবন

প্রাচীন গ্রিসের ইলিয়া (ওষরধ/ঊষরং) নামক ছোট নগরের একজন দার্শনিকের নামে একটি গল্প প্রচলিত আছে। এই দার্শনিক প্রবর যখন কিশোর বয়সের ছিলেন, তখন তিনি এক শিক্ষকের কাছে দর্শনের পাঠ নিতেন। এই শিক্ষককে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন ও ভালোবাসতেন। শিক্ষকের তত্ত্ব তিনি শুধু মনে নয়, ব্যবহারিক জীবনেও অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেষ্টা করতেন। শিক্ষকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রত্যেক দিন বিকাল বেলা তিনি হাঁটতেন। একদিন বিকালে তিনি যথারীতি গাঁয়ের পথ ধরে হাঁটছেন। হঠাৎ নজরে পড়ল তারই প্রিয় শিক্ষক রাস্তার পাশের একটি পুরাতন পুকুরের চোরাবালিতে পড়ে হাবডুবু খাচ্ছেন। গুরুর এই দুর্গতি দেখে শিষ্য দাঁড়িয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে ওখানে বসে পড়লেন এবং মুখে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলেন কী তার করণীয়। ওদিকে গুরু মহাশয়ের প্রাণ-প্রদীপ নিভে যাওয়ার পর্যায়ে। এমতাবস্থায়, একজন সাধারণ পথচারী দ্রুততার সঙ্গে পুকুরটিতে নেমে গুরুজিকে উদ্ধার করেন। উদ্ধার পেয়ে গুরু ওই উদ্ধারকারী ব্যক্তিটিকে কোনো ধন্যবাদ দিতেও ভুলে গেলেন, উপরন্তু নীরব দর্শক হিসেবে বসে থাকা তার শিষ্যকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগলেন। কেননা তিনি নিশ্চিত হতে পেরেছেন যে, শিষ্য সত্যিকার অর্থে তার দেওয়া শিক্ষাকে প্র্যাকটিস করা শুরু করেছেন। তিনি তাকে শিখিয়েছিলেন যে, কোনো অবস্থায়ই বিচলিত হওয়া যাবে না, স্থির থাকতে হবে। তবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে গভীরভাবে ভেবে-চিন্তে; আর তার আগে যে কোনো কর্মপন্থাকেই সন্দেহ করতে হবে। সন্দেহ করতে হবে ওই কাজের ফলকে। আদৌ কি কাজটি করা উচিত নাকি উচিত নয় এমন বিষয়ে সার্বিক সংশয় করার নীতিই তিনি ওই শিষ্যটিকে শিখিয়েছিলেন। নিরুদ্বেগ বসে থাকা দেখে তিনি বিষয়টি বুঝতে পারলেন। আর সে কারণেই শিষ্যের প্রতি এত স্নেহ প্রদর্শন।

সমকালীন সময়ে গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের যে অবস্থা তাতে কোনো গুরুই নিশ্চয়ই তার শিষ্যদের ওই ধরনের শিক্ষা দেওয়ার বিষয়ে চিন্তিত থাকবেন। সে যাহোক, যার কৈশরকালের ঘটনাকে এতক্ষণ বর্ণনা করলাম, সেই গ্রিক দার্শনিকের নামই বলা হয়নি। আসলে তিনি হচ্ছেন পিরহো (Pyrrho, 360-170 BC)। সংশয়বাদ বা সন্দেহবাদ (skepticism) নামে দর্শনে যে জ্ঞানবিষয়ক মতবাদ রয়েছে সেই তত্ত্বের সঙ্গে তার নাম বিশেষভাবে জড়িত। অধিকাংশ দর্শনের ইতিহাস লেখক পিরহোকেই সংশয়বাদের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বা জনক বলে অভিহিত করেন। তার নাম অনুসারে সংশয়বাদকে অনেকে পিরহোনিজম (Pyrrhonism) বা পিরহোবাদ বলে চিহ্নিত করেন। কী ছিল তার দর্শন বা পিরহোবাদের সারকথা? প্রথমত, এই মতবাদ মনে করে সবকিছুই সন্দেহযোগ্য; কোনোকিছুই বিনা সন্দেহে গ্রহণ করা সংগত নয়। আমাদের কোনো জ্ঞানই সুনিশ্চিত নয়। অর্থাৎ আমরা যা জানি তা ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সর্বসময়েই। তাই কোনো কিছু সম্পর্কে কোনো কর্মপন্থা যে আমাদের জন্য ভালো হবে তা আমরা জানি না। তাই কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা ঘটনার প্রতি আস্থা রাখা অনর্থক। শুধু সেটাই করা দরকার যা জীবনের নিতান্ত প্রয়োজনে করতে হয়। আর যা করছি তার ফল যে সর্বদা ভালো হবে আমাদের পক্ষে যাবে এমন ভাবনা থেকেও আমাদের সরে আসতে হবে। দ্বিতীয়ত, পিরহোবাদের আর একটি শিক্ষা হলো, কোনো অবস্থাতেই বিচলিত হওয়া বা ভেঙে পড়া যাবে না। যেহেতু কোনোকিছুর সম্ভাবনাই নাকোচ করা যায় না। ভালো মন্দ যে কোনোটাই ঘটতে পারে সে বিষয়ে আমরা কোনো সুনিশ্চিত জ্ঞানই রাখি না। তাই সব ধরনের ফলের জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। মনকে এভাবে উদ্বেগমুক্ত ও শান্ত করার বিষয়টিকে পিরহো একটি শব্দ দিয়ে প্রকাশ করেছেন তা হলো “ধঃধৎধীরধ”. এই উদ্বেগমুক্ত শান্ত মন লাভ করারই পিরহোবাদের মূল লক্ষ্য। পরবর্তীতে এপিকিউরিয়ান ও স্টোয়িক দার্শনিকরাও তার এ ‘শান্ত মন’ লাভের বিষয়টিকেই জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে অনুমোদন করেন।

পিরহোবাদের তৃতীয় বা চূড়ান্ত স্তর হিসেবে যে বিষয়টিকে ধরা যেতে পারে তা হলো কঠোর সাধনা, বৈরাগ্য এবং দৈহিক নিয়ন্ত্রণ। যে কোনো মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা হচ্ছে প্রথম কাজ। পিরহোর মতে, সুখী হতে হলে সর্বপ্রথম এটাই মনে রাখতে হবে যে, সুখ কামনা করা বা ভালো ফল কামনা করা একেবারেই অসুখী হওয়ার পথ। কেননা কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়। সবচেয়ে মন্দভাগ্যের জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে। তাহলেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালো ফল যদি হয়ে যায়, তাহলে তা থেকে বিমল আনন্দ বা সুখ লাভ করা সক্ষম হবে। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, যৌন কামনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কঠোর সংযমী হওয়ার শিক্ষা দেয় পিরহোবাদ। অনেকের মতে, পিরহোর এই ধরনের মতাদর্শের পেছনে ভারতীয় দর্শনের কিছু ধারার সরাসরি প্রভাব রয়েছে। আর পিরহো নিজে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এর নৌবহরের সঙ্গে একবার ভারত এসেছিলেন।

দর্শনের কথা, তত্ত্বের কথা এবার থাক। আশা যাক আমাদের যাপিত জীবনে। বাস্তবজীবনে আমরা অনেককেই এমন সন্দেহ-বাতিকগ্রস্ত দেখি, যারা কোনো কিছুতেই যেন আস্থা রাখতে পারেন না। জীবন সম্পর্কে হতাশ। একান্ত কাছের মানুষ, পরিবারের মানুষের প্রতিও আস্থা নেই। এমনকি আস্থা নেই নিজের ওপরও। এটা শুধু বয়স্ক মানুষের বেলায় না, বোধ-বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত অনেকেরই এই অবস্থা। অনেক প্রতিভাবান সামর্থ্য তরুণ-তরুণীর মধ্যেও এই সর্বগ্রাসী সন্দেহ-বাতিক বিদ্যমান। এই অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়েই এক বাঙালি কবি বলেছিলেন : ‘একান্ত অনাস্থা গাঢ় মনেতে আমার/আস্থা নেই সৌন্দর্যে, আশ্বাসে, প্রত্যাশায়/আস্থা নেই মথিত হৃদয়াবেগে/আস্থা নেই আলোতে, যৌবনে।’ এ ধরনের তরুণ-তরুণীরা সমাজের জন্য তো দূরের কথা নিজের জীবনকেও আলোকিত করতে অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। এরা প্রেমিক-প্রেমিকা হিসেবেও একে অন্যকে সারাক্ষণ সন্দেহ করে। কোনো উদ্যোগ নিতে গেলে বারবার নেতিবাচক চিন্তা করে। কোনো নতুন কিছু করার প্রস্তাবনা পেলে, অনেক বড় কোনো পরিকল্পনা বা সম্ভাবনা সামনে এলেও এরা ভাবে : ‘লোকে কী বলবে, যদি ব্যর্থ হই তাহলে কী হবে। আমর দ্বারা হয়তো কিছুই হবে না। অতীতে অনেকবার ব্যর্থ হয়েছি, তাই এবারও হয়তো ব্যর্থ হবো। সমাজে আর মুখ থাকবে না। এদেরকে উদ্দেশ্য করে এক কবি বলেন : ‘করিতে পারি না কাজ/সদা ভয় সদা লাজ/সংশয়ে সংকল্প সদা টলে/পাছে লোকে কিছু বলে।’ এভাবে সংশয় বা সন্দেহে যাদের সংকল্প টলে পরে, তারা সত্যিকারভাবেই বড় কোনো কাজ করতে পারে না। সন্দেহ-বাতিক তাদের সব সম্ভাবনাকে বাতিল করে দেয়। জীবনের নানা পর্বে মানুষকে বিচিত্র রকমের কাজ করতে হয়। বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে কাজ করতে হয়। কিন্তু কোনো সন্দেহ-বাতিকগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কোনো রকম কাজ করে, বা সম্পর্ক রেখে কেউ শান্তি পায় না। এমনকি ঘর-সংসার করেও না। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে থেকেও যদি পরস্পরের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করেন, তাহলে সেই সংসারে শান্তি থাকে না। সেই পরিবারের সব সদস্যেরই কাক্সিক্ষত অগ্রগতি বা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। মজার ব্যাপার হলো এ ধরনের গোড়া সংশয়বাদীদের প্রায় সবাই; কিন্তু পিরহো-এর সঙ্গে সম্পর্কহীন। অর্থাৎ পিরহোবাদ তো দূরের কথা দর্শনের কোনো গ্রন্থই হয়তো তারা কখনও পড়েননি। পড়লে ভালো হতো; কেননা দর্শনে এমন নানা রকমের সংশয়বাদী মতবাদ রয়েছে। দেকার্ত নামক একজন ফরাসি দার্শনিক, যাকে আধুনিক দর্শনের জনক বলে অভিহিত করা হয়, তিনি ‘পদ্ধতিগত সংশয়’ (methodological doubt) নামক দার্শনিক সত্য আবিষ্কারের পদ্ধতি হিসেবে এক ধরনের সংশয়কে অনুমোদন করেছেন। বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ‘দার্শনিক সংশয়’ (philosophic doubt) নামক যে সংশয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে দর্শনচর্চার জন্য জরুরি মনে করেছেন তা-ও এক ধরনের প্রারম্ভিক সংশয়, সার্বিক সংশয় নয়। আপনি যদি দার্শনিক, এমনকি বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কার করতে নিবেদিত হয়ে থাকেন, তাহলে ওই একাডেমিক কাজের ক্ষেত্রে আপনি পুরোমাত্রায় সংশয়ী হতে পারেন; বিশেষ করে, সত্যে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত। রাসেলের অগ্রজ স্কটিস্ট দার্শনিক ডেভিড হিউম আর একটু বেশি মাত্রায় সংশয়বাদী ছিলেন, তিনিও বলতেন : ‘রবিবারে আমি একজন ভিন্ন মানুষ।’ কেননা ছুটির দিনে তিনি যেহেতু একাডেমিকভাবে দর্শনচর্চা করেন না, তাই তিনি ওইসব সংশয়ও তার ব্যক্তিগত জীবনের প্রাত্যহিক কাজকে ব্যাহত করে না। এমনকি দর্শনের গবেষকদেরও তিনি বলেছেন : ‘দার্শনিক হও; কিন্তু সব দার্শনিকতার মধ্যেও তুমি যে একজন সাধারণ মানুষ একথা ভুলে যেও না।’ কিন্তু সন্দেহ-বাতিকগ্রস্ত কুটিল স্বভাবের লোকরা এসব কথায় কান দেন না। অনেকই এদের চেনেনও না। সন্দেহ তাদের স্বভাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। মানুষ সম্পর্কে তাদের ধারণা খুবই নিম্নমানের, এমনকি নোংরা রকমের। কেননা তাদের নিজেদের আপন ভুবনটিও অন্ধকার।

এদের মধ্যে অনেকেই অসুস্থ। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘আবেষায়িত বাধ্যকরণ বৈকল্যতা’ ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Obsessive Compulsive Disorder msc OCD, সেই রোগের ধারক এই সব সন্দেহবাদী ব্যক্তিরা। সুতরাং চিকিৎসা প্রয়োজন; নতুবা কেউ তাদের কাছে কোনো সম্পর্কেই নিরাপদ নন। তবে অন্য এক ধরনের সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত মানুষ রয়েছে যারা পারিবারিকভাবে বা কোনো বিশেষ সামাজিক পরিবেশের কারণে সন্দেহ-সমালোচনা ও মানুষ সম্পর্কে সর্বদা নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা চর্চা করে আসছে। এ ধরনের অপসংস্কৃতির শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলাই শ্রেয়।

ড. মো. শওকত হোসেন
অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত