সুন্দরবনে বিস্ময়: দুবলারচরে রাস পূর্ণিমা

কপিল ঘোষ

আপডেট : ০৪:৩৮ পিএম, মঙ্গলবার, ১৬ নভেম্বর ২০২১ | ১৩৮৮

‘সুনদরের টানে মঙ্গল শত্রু’

ঢাকার শ্রাবণ প্রকাশনীর ‘সুনদরের টানে মঙ্গল শত্রু’ বইতে সুন্দবনাঞ্চলের ৫০ বছরের গল্পগুলো উঠে এসেছে। সেই বইয়ে প্রকাশিত ভ্রমণ বিষয়ক লেখা ‘সুন্দরবনে বিস্ময়!’ আসন্ন রাস পূর্ণিমা উপলক্ষে পাঠকের জন্য তুলে ধরা হল।

সুন্দরবনের ‘দূর্বাচর’ কিংবা ‘দুবলারচর’এ রাস পূর্ণিমার উৎসব ঠিক কবে কখন শুরু তা নিশ্চিতভাবে এখনো জানা যায়নি। তবে এখানে দেশী-বিদেশী লাখো পুণ্যার্থীর মিলনমেলায় পরিণত হয়। নতুন আলোয় নৃত্য করে দুবলারচর আলোরকোল। অনেক মানুষ তীর্থের অনুভূতি নিয়ে সেখানে যায়। প্রকৃত তীর্থযাত্রীরা পূর্ণিমা তিথিতে নিরামিষ ভোজন করেন। সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নত করে। বন, মাটি, নদী-সাগরের প্রতি প্রবল বিশ্বসী স্থানীয় মানুষের সাথে ঢাকা ও চট্টগ্রামের একদল তরম্নণ ফিল্মমেকার গিয়েছিল রাস পূর্ণিমার উৎসবে। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস ও বাঘের থাবায় মানুষের প্রাণপাত সহ এই ভ্রমণকালের নানা বিষয় নাগরিক জীবনে অভ্যস্থ মনকে বিস্মিত করে তোলে।

২০১১ সাল। ইচ্ছেটা ছিল অনেকদিনের। নারকেলের ছোবড়ায় ঝিমিয়ে পড়া আগুনে ধুপ ছিটিয়ে দেয় নলিয়ানের বন্ধুরা। শিবসা নদ’র কুলে নলিয়ান জনপদ গড়ে ওঠে প্রায় দু’শ বছর পূর্বে। নলিয়ান পশ্চিম-সুন্দরবনের গুরম্নত্বপূর্ণ এক ফরেস্ট স্টেশন। খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নে এর অবস্থান। সেখানের একঝাঁক তরম্নণ মনে করিয়ে দেয়- ‘দাদা, রাস পূর্ণিমা আইসছে, মেলায় কিন্তু যাতি হবে।’ সেই ইচ্ছে পূরণে অবশেষে যাত্রা শুরম্ন হলো। তীর্থযাত্রা!

  • প্রথম দিন :

রাস পূর্ণিমায় সমূদ্রসণান হবে ১০ নভেম্বর। দুর্বাচর (দুবলারচর) আলোর কোলে, আমাদের সুন্দরবনের বেলাভূমিতে। আর্টফিল্ম মেকার ঢাকার বন্ধুরা আসলো। সুন্দরবনের কোলের গ্রামগুলোর স্থানীয় সাধারণ মানুষের সাথে রাস পূর্ণিমায় দুর্বাচরে যাওয়ার অনুভুতি তো ভিন্ন। এখানে রয়েছে তাঁদের সুন্দরবনের প্রতি বিশ্বাস, আচার, অনুষ্ঠান, প্রথার নানা বিষয়। ফিল্মমেকার বন্ধুদের দলে যোগ হয় মোলস্নাহাটের রামায়ন গানের দল। প্রথমে গাজীর গানের জন্য বাগেরহাটের দেপাড়া গ্রামের রফিকের দল ঠিক ছিল। তাদের বায়নার টাকা বেশি, যার যোগান দিতে আমরা অপারগ। শেষ পর্যমত্ম তাদের অপারগতায় মহাভারতের নাম উচ্চারণ!

বাতাসে দোতরা, বেহালা, বাঁশের বাঁশি, ঢোল, করতাল, গীটারের সুর-শব্দ আর স্বরের খেলা শুরম্ন হয়। রামপালের দোতরা বাদক অমল ঘোষাল স্বদলবলে তীর্থসঙ্গী হয়ে বোহেমিয়ানের পথে পা রাখেন। চেপে বসেন সমূদ্রমুখি ইঞ্জিন নৌকায়। দিনটি ছিল ৮ নভেম্বর, ২০১১ দুপুর আড়াইটা। ট্রলারের ভটভটানি শব্দযন্ত্রণায় কাতর হয়ে রামায়ন গানের শিল্পী কলা-কুশলীরা তাদের বাদ্যযন্ত্র কাপড়ে বন্ধি করে রাখেন। তাদের চোখ আটকে যায় সুন্দরবনের সবুজ আলোয়। একপাশে লোকালয় আর অপরপাশে সুন্দরবন- আমরা ভেসে চলেছি ভদ্রানদীর বুক বেয়ে।

এসব দৃশ্যাদি ক্যামেরা বন্ধি করছে ফিল্মমেকার বন্ধু। এই যাত্রায় আমার ভূমিকা অনুঘটকের। রামপালের ভাগা গ্রাম হতে চালনা, দাকোপ, কালীনগর, শ্রীনগর হয়ে সুতারখালীর কালাবগী গ্রামে পৌঁছাই সন্ধ্যা ছয়টার দিকে। কালাবগী গ্রামের অরম্নণ মন্ডল, মমতা রানী, স্থানীয় মহিলা মেম্বার বিউটি রানীসহ কালাবগী গ্রামবাসী আমাদের স্বাগত জানালেন। নদীতে তখন ভাটা। ট্রলারের নির্দিষ্ট কোন ঘাট নেই। দীর্ঘদিন পর নদীচরের কাদামাটিতে একাকার হলাম। শীতল হলো শরীর।

  • দ্বিতীয় দিন :

০৯ নভেম্বর, ২০১১ বিকেল সাড়ে চারটা। বাংলাদেশের দক্ষিণে লোকালয়ের শেষ একটি জনপদ কালাবগী গ্রাম। এ গ্রামের ওপারেই সুন্দরবন। গ্রামের পূর্ব-দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ইংরেজী ইউ আকৃতির নদীর বাক- কুমিরের আবাসস্থল ভদ্রা নদী ও শিবসা নদ’র মিলন হয়েছে এখানে।

কালাবগী গ্রামের পূর্বপাড়ে সুন্দরবন। ওপারে গিয়ে সুন্দরবনের মা বনবিবি’র থানে মানত করে এলেন স্থানীয় বাওয়ালী ফনিভূষণ। সহজসরল স্বভাবের সুঠামদেহী ফনিভূষণই আমাদের দুবলারচর যাত্রাপথের কান্ডারী। অথচ তিনি নিরক্ষর-প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার তিনি ধার ধারেন না। সুন্দরবনের প্রতি অগাধ বিশ্বাসে দিন-রাত অবলীলায় পড়ে থাকেন সুন্দরবনের গহীনে। দু’চোখ তাঁর উজ্জ্বল- সারাক্ষণ হাসিভরা মুখ। সে কখনো ক্ষেপলে তাকে নাকি থামানো দায় হয়ে পড়ে। আমাদের যাত্রার সময় ঘনিয়ে আসে।

রামপাল হতে নিয়ে আসা আমাদের বড় ট্রলারের সাথে যুক্ত হলো কালাবগীর ছোট একটি ট্রলার। মহিলা মেম্বার বিউটিরানীসহ কালাবগী গ্রামের তীর্থযাত্রী গৃহস্থবাড়ির শিশু, গৃহবধু, কিশোর-কিশোরী ও তরুণণরা সঙ্গী হল। অরম্নণ আলোয় কালাবগী গ্রামের প্রথা অনুযায়ী, বাস্ত্তভিটা ও নদীঘাটের মাটি-সিঁদুর-তেল-জল কপালে ছুঁইয়ে দু’টি ইঞ্জিন নৌকা ঘাট ছাড়ল। বেজে উঠলো শঙ্খ-কাঁসা আর উলুধ্বনী।

  • আরো তীর্থযাত্রী :

দলবেধে নৌকায় ভেসে ছুটছে তীর্থযাত্রীরা। আমরাও ভাসছি শিবসা নদ’র ঢেউয়ের তালে। ওয়াপদা বেড়িবাধে কালাবগী জনবসতির ঝুলমত্ম টংঘরগুলো ধীরে ধীরে দুরে চলে যায়। সুন্দরবনের যে নদীতে কুমির, হাঙ্গর আছে- বইতে পড়েছি, এই সেই ভদ্রা নদী। এখনো দেখা মেলে কুমিরের, মাঝেমধ্যে। ভদ্রাকে ফেলে এসেছি কালাবগীর পূর্ব প্রামেত্ম। সুন্দরবনের বুকে শিবসা নদ-এ ভাসতে ভাসতে লোকালয় জনপদ চোখের আড়াল হয়।

দু’পারে সুন্দরবন। সবুজ অরণ্য। সুন্দরবনের বাইরের অংশে বাঘের চাপ বেড়েছে সম্প্রতি। বাঘের ডাক-হুঙ্কারে, আনাগোনায় এবার অনেক বাওয়ালি মধুসংগ্রহে যেতে পারেনি। মৌচাক, কাঁকড়া বাঘের প্রিয় খাবারের তালিকার শীর্ষে। সেখানে ভাগ বসিয়েছে মানুষ। এখন বাঘ, কুমিরসহ সবাই ক্ষুধার্ত! অনেকটা বাধ্য হয়ে-ই তাই তারা দু’একটা মানুষ ধরে, লোকালয়েও আসে। আর ওদিকে সমূদ্র রেগে উঠেছে। সিডর-আইলা আরো কতনামে সে ফুঁসে উঠছে মাঝে মাঝে।

এমনি এক পরিস্থিতিতে সাপের চলার মতো পথে জলের স্রোতে ভাসছে মানুষ। সারিবাধা শত নৌকা-ট্রলার-লঞ্চে তারা সমূদ্র অভিমুখে যাত্রা শুরম্ন করেছে। সুন্দরবনের দুবলারচর আলোরকোলে এবার সমূদ্রমন্থন হবে কি-না জানিনা, তবে এটুকু জানি- প্রতিবছরের ন্যায় এবারো প্রচলিত জাত-ধর্ম নির্বিশেষে হাজার হাজার পূণ্যার্থী তাদের সমূদ্রের কাছে করা ‘মানত মাঙ্তে’ যাচ্ছে। দেশি-বিদশী শত শত পর্যটকও মিলে গেছে এই তীর্থযাত্রীদের বহরে।

দুঃসাহসিকতা!

রাতভর চলল আমাদের ট্রলার। রাতের পথে আছে ডাকাতের ভয়। চারপাশে সুন্দরবন আর নদীর চোরাগলিপথ। নদীতে কুমির-হাঙ্গর আর ডাঙ্গায় বাঘ-সাপ আরো কতো কী! ভোররাতের জোৎসণার আলো, মৃদু-কুয়াশায় সবনদীপথ যেন একাকার হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আমরা যেন ঘুরেফিরে একপথেই চলছি। যা চলে চলুক, ট্রলার থামানো যাবেনা। অপরিচিত অন্য কোন ট্রলারকেও পাশে ঘেঁষার সুযোগ দেয়া যাবে না। কে জানে কোন ট্রলারে আছে সুন্দরবনের ডাকাতদের সেই লোকেরা।

প্রত্যেকটি ট্রলার এমন সতর্কতার সাথে দুরত্ব বজায় রেখে ছুটছে। শিশুরা ঘুম। নারীরা ট্রলারের খোলে নিরামিষ রান্নার কাজে ব্যসত্ম। সমূদ্রসণানের আগে কেউ মাছ-মাংস খাবেনা। স্থানীয় যুবকদের হাতের কাছে রয়েছে দা-লাঠি, সদা সতর্ক তারা। কিন্তু তাদের এই সতর্কতা বাইরের অতিথিদের কোনভাবেই বুঝতে দিতে চায়না। প্রতিবছর এভাবেই যাত্রা করায় তাদের আনন্দ। মাঝে মধ্যে দুর হতে সার্জলাইট জালিয়ে ফরেস্টার কিংবা কোস্টগার্ডের বোট দ্রম্নত ছুটে যেতে দেখা যায়।

টাইগার পয়েন্টের কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ আমাদের বড় ট্রলারটি ডুবোচরে আটকে গেল। ধাক্কায় চিৎকার করে উঠলো সবাই। ভয় পেলাম। পেছন দিক হতে দ্রম্নত ছুটে আসে কালাবগীর সেই ছোট্ট ট্রলারটি। চলমত্ম অবস্থায় বড় টলারের হেলপারের কাছে দড়ি ছুড়ে দিয়ে বাধতে বলে। তার ভাব এমন যে, চরে আটকে যাওয়া ট্রলার এক ধাক্কাতেই সে ছাড়িয়ে নেবে। পেছন থেকে এসে আমাদের পাশ কাটিয়ে দড়ি দিয়ে দ্রম্নত গতিতে সে ছুটে যায় ডানদিকে। ঘটনা যা ঘটার তাই ঘটল। হাতির মতো বিশালদেহীকে কী আর চুনোপুঁটি নড়াতে পারে? বিকট শব্দে ছোট-ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধ হল, ছুটে গেল দড়ি- উল্টেপড়ার হাত থেকে একটুর জন্য রক্ষা পেল তারা।

অতঃপর কী আর করা। ঝটপট ট্রলারে গলুই ধরে নেমে পড়লেন নলিয়ানের আসলাম ভাই। যত দেরি হবে ততই চরের বেলেমাটিতে আটকে যাবে, আর তা হলে দুবলারচরে সূর্য্যোদয়, সমূদ্রসণান আর হবেনা! রয়েছে আরো নানা বিপদ-আপদ। চারিদিকে নদীর ঢেউ, অন্যান্য ট্র্লারগুলো পাশে না ঘেঁষে আরো দুর সরে ছুটে যাচ্ছে। আসলামের দেখাদেখি আরো কয়েকজন নেমে দ্রম্নত ট্রলারের তলদেশ হতে মাটি সরিয়ে পেছনদিকে ঠেলে গভীর পানিতে ভাসলো। ততক্ষণে ছোট ট্রলারের ইঞ্জিন চালু হয়েছে। এবার বন্ধু তৌফিক, অপুসহ আমরা কয়েকজন হো হো করে হেসে উঠলাম। আমাদের হাসির শব্দে ছোট ট্রলারের লোকরা যোগ দিল আনন্দে।

সূর্য্যরশ্মির দেখা মিলল সুন্দরবনের পূর্ব-আড়াল হতে। যাত্রা আবার শুরু হলো।

শেষ দিন ১০ নভেম্বর।

সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সমূদ্রসণান। নারী, পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, যুবক-যুবতী কয়েক লক্ষ পূণ্যার্থীর ঢল। হাজার হাজার নৌকার পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে ভাসছে জাহাজ, পর্যটকদের লঞ্চ।

ব্যতিক্রমী মানত দেখি এখানে- কচুরমুখি, কচুরগাটি অথবা কচু কেটে সাগরের প্রতি নিবেদন করে প্রসাদ। কেউ কেউ পাঠাও (খাসি) ভাসিয়ে দেয়। এরপর অন্যান্য আচারাদি সম্পন্নের পর শুরম্ন হয় সমূদ্রসণান। তারপর মেলা দেখে নৌযানে বাড়ি ফেরার পালা। আরো অনেক কিছু রয়েছে লেখার স্বল্প পরিসরে আজ আর নাই-বা বললাম।

  • তীর্থযাত্রীদেরক্ষোভ :

প্রতিবারের ন্যায় এবারো কালাবগী-নলিয়ানের তীর্থযাত্রীরা নীলকমল ফরেস্ট অফিস থেকে রাজস্বের পাস করবেন বলে ভেবেছিলেন। লোকালয় চোখের সীমানা পেরিয়ে যেতেই, দূর থেকে একটি স্পীডবোট ছুটে এলো কাছে।

স্থানীয়রা বললেন,

এটি ডিএফও’র (বিভাগীয় বন কর্মকর্তা) বোট। তাঁরা এসেই তীর্থযাত্রী ২টি ট্রলারের লোকদের ধমক শুরম্ন করলেন- পাস না পেয়ে। স্থানীয় মহিলা মেম্বার বিউটি রানী, কালাবগী পন্ডিতচন্দ্র রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি অরুণ রায়সহ অন্যান্যরা যতই তাদের বোঝাতে চাইলেন- প্রতিবার তো নীলকমল থেকে পাস কাটা হয়। কিন্তু তারা শুনতে নারাজ। এরপর তারা ২টি নৌকার পাস (রাজস্ব) কাটলেন- একটিতে ২৩ জন পূর্ণবয়স্কের জন্য প্রায় ৩১শ’ টাকা, অন্যটিতে ৫জন শিশুসহ ১৮ জনের জন্য ২৭শ’ ১৩ টাকা। রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকার মধ্য থেকে তীর্থে যাচ্ছে- এই আইন তো মানতেই হবে!

অরুণ বাবু ও বিউটি দিদি জানান, এর আগে জনপ্রতি ৫০ টাকা ও ট্রলার প্রতি ৫শ’ টাকা দিতে হতো, শিশুদের জন্য কোন ফি’ দেয়া লাগতো না। কিন্তু এবার শিশুদের জন্যও টাকা দিতে হলো! ট্রলার প্রতি নিল ৮শ’ টাকা, অবস্থান ফি-৬শ’ টাকা, আরো কী যেন! তারা আরো বলেন, আমরা তো আর পর্যটক নই। ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে প্রতিবছর মানত মাঙতে যাই। তীর্থযাত্রীদের সাথে এহেন আচরণ, আর্থিক নিষ্পেষণ হলে কিভাবে চলবে? মনটাই তো ভেঙ্গে যায়! দুবলারচরে আসা অন্যান্য তীর্থযাত্রীরাও বনবিভাগ ও নৌ-বাহিনী, কোস্টগার্ড সদস্যদের অশোভন আচরণ এবং অতিরিক্ত অর্থ (রাজস্ব) আদায়ের ব্যাপারে অভিাযোগ করেন।

খুলনার প্রবীণ সাংবাদিক ও শিশু সাহিত্যিক জ্যোতির্ময় মলিক। আবেগজড়ানো ভাষায় স্মৃতিচারণ করেন তিনি। ১৯৬৬ সালের দিকে আমিও দুবলারচর রাস পূর্ণিমায় সমূদ্রসণানে গেছি। আমরা গেছি কাঠের পানসি নৌকায় চড়ে, কারুকার্য খচিত বিশাল আকৃতির সে নৌকা। ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ছিলনা। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। এখনকার করমজল ফরেস্ট অফিসের নিকটস্থ ঢাংমারী খালের পাশে ছিল কুদকাটার (রাজস্ব) অফিস। তীর্থযাত্রীদের কাছ থেকে জনপ্রতি কুদ (রাজস্ব) নিয়েছিল আড়াই (২.৫০/=) টাকা -পরিস্কার মনে আছে, আর নৌকা কিংবা অন্য কোন কিছুতেই খরচ ছিলনা।

  • প্রচলিত রীতিনীতি- মানুষের বিশ্বাস; সমূদ্রস্নান ও মানত :

সনাতন তীর্থস্থান সুন্দরবনের দুর্বাচর ওরফে দুবলারচর। এই মিলনমেলায় কোন জাতি-ধর্মের ভেদাভেদ নেই মেলায়। ঠিক কবে হতে দুর্বাচরে বা দুবলারচরে সমূদ্রস্নান শুরু হয়েছে তা সঠিক বলা যায় না। তবে মানুষের বিশ্বাস, তারা মনোবাসনা পূর্ণ করতে যে মানত করে, তাই পূরণ হয়- বিশ্বাসটা চাই অটুট !

কেউ কেউ মনে করে- তার যত পাপ সব ভাসিয়ে দিতেই এখানে সমূদ্রসণানে আসতে হয়। নিজের সন্তানকে নিবেদন করছে- এই মনে করেও অনেকে কাটা কচু, ডাব অন্যান্য ফলমূল নিবেদন করে- গঙ্গা, বনবিবি ও রাধাকৃষ্ণকে!

সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া স্বামীর প্রতিক্ষায় থাকা কোন গৃহবধু মানত করে স্বামীর প্রাণ যেন তার কাছে ফিরে আসে! সন্তান কামনায় মানত করে কোন নারী। দুরারোগ্য কোন ব্যাধি সারাতেও মানত করে অনেকে। নদ-নদীতে যেন এবার বেশি মাছ পাওয়া যায়- সেজন্য মানত মাঙতে ব্যতিব্যাসত্ম থাকে জেলেরা।

কালাবগীর ঘাট থেকে যাত্রা শুরম্নর সময় মানত করে মাটিতে কপাল ছুঁইয়েছিলেন বাওয়ালী ফনিভূষণ, সঙ্গে অন্য তীর্থযাত্রীরাও। নীলকমল হয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে ৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় দুবলার চরে নামলাম। মূল মন্দিরের দিকে পা বাড়াতেই ফনি কানের কাছে এসে বললেন,‘সোয়া ১০ টাকার ৩ টোপলা ভোগ দিও মন্দিরে।’ আছলাম ভাইয়ের হাত ধরে মন্দিরের কাছে পৌঁছাতেই মনে প্রশ্ন জাগলো- কার কান জন্য ৩ টোপলা ভোগ? উত্তর দিলেন আছলাম- ‘গঙ্গা, মা বনবিবি এবং রাধা-কৃষ্ণের জন্যে।’ রাধাকৃষ্ণের রাসলীলার দিন এটি, তাই বনে নামা নিষেধ!

  • বাঘের থাবায় মানুষের প্রাণ !

কাকতালীয় না-কি অন্যকিছু সেটা ঠিক বলতে পারবো না। কিন্তু এটাই সত্যি- বাঘের শিকার হলো ছেলেটি! নাম বেলাল (১৭), বাড়ি সুতারখালী। পুরো পা-টিই তার খেয়ে ফেলেছে বাঘে। থাবাটা বসিয়েছিল গলায়, ঘাড়টা ভেঙ্গে কাত হয়ে পড়েছিল লাশের। মাছ ধরার জন্য সুন্দরবন চরেরখালের খাদে মাছ ধরার জন্য জাল মাটিতে পুতছিল ওরা ৩ জন পুরুষ। পাশে থামানো নৌকার ছঁইয়ের সামনে বসে একজন মধ্য বয়সী নারী শিবসায় বর্শি ফেলে থিতু হয়ে বসে আছে সেদিকে চেয়ে। পেছনটা তার বনের দিকে। ৩০/৩৫ হাত দূরে আরেকটি নৌকা থামানো, সেখানেও অপর ৩ পুরুষ একইভাবে জাল গুজে চলেছে বনের মাটিতে।

তখন ভাটি, সন্ধ্যা নামবে। পশ্চিমে সূর্যের রক্তিম আভা, ১০ নভেম্বর,২০১১। তীর্থ থেকে সংসারমুখি আমাদের নৌযানের বন্ধুদের, বিশেষত ঢাকার বন্ধুদের মনটা ভীষণ খারাপ। কারণ- সুন্দরবনের ভিতরের মাটিতে হাঁটা হয়নি। যখনই যেতে চেয়েছে, তখনই বাওয়ালী ফনিভূষণ বাধ সেধে বলেছেন- ‘রাস পূর্ণিমার দিন, মালে উঠতে নেই!’ সকাল থেকে সারাদিনের ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেল জেলেদের বনে নেমে মাছ ধরার দৃশ্য দেখে। অনেকেই বাওয়ালীকে উপহাস-বিদ্রুপের বাক্যবান ছুড়লো, কেউ কেউ উৎসাহিতও করলো বনে নামার জন্য। কিন্তু ফনি বাওয়ালী অনঢ়। শুধু হেসে দিয়ে নিজের ভাষায় বললেন,‘বিশ্বাসে মেলায় বস্ত্ত তর্কে বহুদূর!’

সুন্দরবনের এপারে ঝুলন্ত ঘরগুলোর পাশে নলিয়ানের আছলাম ও বাওয়ালী ফনিভূষণ নেমে পড়লেন- হেঁটে আগেভাগে বাড়ি যাবেন বলে। আধাঘন্টার মাথায় কালাবগীর ঘাটে আমাদের নৌযান ভিড়লো। পাড়ে দাড়িয়ে আমাদের অপেক্ষায় ফনি বাওয়ালী। ট্রলারের শব্দ থামতেই তিনি জানালেন, যাদের মাছ ধরতে দেখে এসেছি- তাদের মধ্য থেকে সুতারখালির একটি ছেলেকে বাঘে নিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে!

আমাদের পেছনের ট্রলারটি এলো, নিমাই জানালো- ঘটনা সত্যি, নদীর পাড়ে যারা ছিল তাদের একজনকে নিয়েছে। বাকীরা নৌকায় উঠে এসেছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে তাই বনে কেউ ঢুকতে সাহস করেনি। কথাগুলো তখনো গল্প মনে হচ্ছিল। কিন্তু পরদিন এলাকার লোকজন গিয়ে যখন ছেলেটির লাশ নিয়ে এলো তখন লাশটি দেখলাম। লাশ দেখার জটলায় অনেকের ভিড়ে ফনি বাওয়ালীও ছিলেন। ট্রলারে বসে বার বার উচ্চারিত শব্দগুলো মনে পড়ছিল- ‘বিশ্বাসে মেলায় বস্ত্ত তর্কে বহুদুর!’ #

লেখক : কপিল ঘোষ,

সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী,

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত