রূপসা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির অধিক মুনাফার প্রলোভন

শতাধিক পোশাক শ্রমিকের কাছ থেকে আড়াই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও ৮ কর্মকর্তা

মহিদুল ইসলাম, শরণখোলা

আপডেট : ০৬:০৮ পিএম, বুধবার, ৩ আগস্ট ২০২২ | ৫৪১

শরণখোলার শতাধিক পোশাক শ্রমিকের কাছ থেকে প্রায় আড়াই কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে একটি ভূয়া মাল্টিপারপাস কোম্পানির বিরেুদ্ধে। অল্প সময়ে অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে ‘রূপসা মাল্টি পারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ নামের ওই কোম্পানির ৮ কর্মকর্তা-কর্মচারী এই বিপুল টাকা হাতিয়ে এখন গা ঢাকা দিয়েছেন।

এদিকে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া অর্থ দিয়ে প্রতারক চক্রটি শরণখোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় তাদের নামে-বেনামে জমি ক্রয় ও আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন। শর্ত ছিল এই কোম্পানিতে টাকা জমা রাখলে শতকরা ২০% লাভ দেওয়া হবে গ্রাহককে। সেই আশায় বা লোভে পড়ে বিভিন্ন মেয়াদে তারা টাকা জমা রাখেন সেখানে। একসময় সাধারণ এসব গ্রাহক জানতে পারেন কোম্পানিটি ভূয়া। পরবর্তীতে গ্রাহকরা তাদের জমাকৃত টাকা ফেরত পেতে অফিসে গেলে গড়িমসি শুরু করেন। একপর্যায়ে বিভিন্ন মাস্তান দিয়ে ভয়ভীতি দেখানো শুরু করেন গ্রাহকদের। এর পর প্রতারকরা শত শত গ্রাহকের টাকা ফেরৎ না দিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। এখন ফোন করলেও তারা রিসিভ করেন না আবার অনেকের ফোন বন্ধ করে রেখেছেন বলে জানান ভুক্তভোগীরা।


বুধবার (৩ আগস্ট) সকালে প্রতারণার শিকার এমন ২১ জন পোশাক শ্রমিক নারী-পুরুষ শরণখোলা প্রেসক্লাবে এসে সাংবাদিকদের কাছে এই অভিযোগ করেন। এর আগেরদিন মঙ্গলবার বিকেলে তারা কোম্পানির প্রধান উন্নয়ন কর্মকর্তা আলগমীর বেপারীর শরণখোলার উত্তর কদমতলা গ্রামের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ করতে থাকেন। তারা সেখানে অবস্থান নিয়ে প্রতারণার টাকায় নির্মিত ওই বাড়ি তাদের বলে দাবি করেন। ভুক্তভোগী সবাই চট্টগ্রামে বিভিন্ন পোশাক কারখানার (গার্মেন্ট) শ্রমিক।

অভিযোগে জানা যায়, ২০১৮ সালে প্রতারক চক্রটি রূপসা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি খুলে চট্টগ্রামের সিইপিজেড মোড়ের চৌধুরী মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় অফিস ভাড়া নিয়ে ওই ৮ ব্যক্তি তাদের কার্যক্রম শুরু করেন। তারা বিভিন্ন পোশাক কারখানায় কর্মরত সহজসরল শ্রমিকদের লক্ষ্য করেই এই প্রতারণার ফাঁদ পাতেন। অধিক লাভের প্রলোভনে পড়ে কেউ দেড় লাখ, দুই লাখ থেকে শুরু করে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ওই কোম্পানিতে দীর্ঘ মেয়াদী, স্বল্প মেয়াদী, এককালিন আমানত, এফডিআর, ডিপিএসসহ বিভিন্ন প্যাকেজে জমা রাখেন তদের কষ্টার্জিত অর্থ। এছাড়া ওই প্রতারক চক্রটি রূপসা কিং গ্রæপসহ আরো বিভিন্ন নামে কয়েকটি কোম্পানি খুলে ভিন্ন ভিন্ন পদ-পদবী ধারণ করে প্রতারণার জাল বিস্তার করেন। তারা এসব ভূয়া কোম্পানির নামে চট্টগ্রামে কর্মরত দেশের অন্যান্য এলাকার অসংখ্য পোশাক কর্মীর কাছ থেকে আরো কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

কোম্পানির চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা নোয়াপাড়া গ্রামের আমজাদ আলীর ছেলে মো. মজিবুর রহমান। বাকি ৭টি পদের মধ্যে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামের বাবুল খানের ছেলে মো. নাঈম খান কোম্পানির ইউনিট ম্যানেজার এবং তার ভগ্নিপতি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার তেঁতুলবাড়ি বাজারের হাকিম বেপারীর ছেলে মো. আলমগীর বেপারী হলেন কোম্পানির প্রধান উন্নয়ন কর্মকর্তা।

ভুক্তভোগীদের পক্ষে লিখিত অভিযোগকারী চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মো. জসিম উদ্দিন আকন জানান, শরণখোলা ও মঠবাড়িয়ার এই দুই শালা-ভগ্নিপতি চট্টগ্রামের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় কর্মরত শরণখোলার শ্রমিকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করেন। প্রধান উন্নয়ন কর্মকর্তা আলমগীর বেপারী প্রতারণার টাকা দিয়ে শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়নের উত্তর কদমতলা গ্রামে তার স্ত্রী পারভীন আক্তারের নামে ৫কাঠা জমি কিনে সেখানে দুই তলা আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন। জমিসহ তার এই বাড়ির মূল্য প্রায় কোটি টাকা। এছাড়া ইউনিট ম্যানেজার নাঈম খানও দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামে পাকা বাড়ি নির্মাণ করেন। তারা উভয়ই এখন আত্মগোপনে রয়েছেন। এছাড়া কোম্পানির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান ও অন্যরা চট্টগ্রামসহ তাদের নিজ নিজ এলাকায় অঢেল সম্পদ গড়েছেন।


প্রতারণার শিকার পোশাক শ্রমিক বেল্লাল হোসেন জানান, মাল্টিপারপাস কোম্পানির কর্মকর্তা আলমগীর বেপারী এবং নাঈম খান তাদের কোম্পানিতে টাকা আমানত রাখলে শতকরা ২০% লাভ দেওয়া হবে বলে পোশাক শ্রমিকদের লোভ দেখান। তাদের কথায় আশক্ত হয়ে বেশি লাভের আশায় তিনি ২০১৯ সালের ১৫ নভেম্বর ১০লাখ টাকার ডিপোজিট করেন। কিন্তু এখন লাভতো দূরের কথা আসল টাকাও পাচ্ছেন না।

এভাবে আলমগীর বেপারী ও নাঈম খানসহ ভূয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা পোশাক শ্রমিক রিমা বেগমের কাছ থেকে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, পারভীন আক্তারের কাছ থেকে ৩ লাখ ১১ হাজার, মজিবর রহমান হাওলাদারের কাছ থেকে ৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা, আ. রহিমের কাছ থেকে ২ লাখ ৩২ হাজার টাকা, নাজরিন বেগমের কাছ থেকে ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা, ফোরকান হোসেনের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা, ডলি বেগমের কাছ থেকে ২ লাখ ৩ হাজার টাকা, দেলোয়ার হোসেনের কাছ থেকে ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা, কুলসুম বেগমের কাছ থেকে ১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা, জলিল শরীফের কাছ থেকে ৪ লাখ ৮৪ হাজার টাকাসহ শতাধিক পোশাক শ্রমিকের কাছ থেকে প্রায় আড়াই কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

ভুক্তভোগীরা জানান, কোম্পানির চেয়ারম্যানসহ সবাই আত্মগোপনে থেকে অন্যান্য কর্মী দিয়ে অফিসের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বহুবার চট্টগ্রামের সিইপিজেড মোড়ের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে তাদেরকে খুঁজে পাননি। প্রথম প্রথম ফোনে যোগাযোগ করে টাকা ফেরৎ চাইলে দেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তারা স্থানীয় মাস্তান দিয়ে তাদেরকে নানা রকম ভয় দেখান। এখন আর তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এ অবস্থায় কষ্টের উপার্জন হারিয়ে শত শত শ্রমিক পথে পথে ঘুরছেন। এব্যাপারে আদালতে মামলা করবেন বলে জানান ভুক্তভোগী শ্রমিকরা।

অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য রূপসা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির চেয়ারম্যান মো. মজিবুর রহমান (০১৭১২৯৯৯৫৭৪/০১৮৬৫৪৭১৭২৫) এবং প্রধান উন্নয়ন কর্মকর্তা আলমগীর বেপারীর (০১৭৩৮৪৮৭৫৬৪) মোবাইল ফোনে কল করা হলে তাদের নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। তবে কোম্পানির ইউনিট ম্যানেজার মো. নাঈম খান মুঠোফোনে বলেন, তিনি এই কোম্পানির একজন বেতনভুক্ত কর্মচারী ছিলেন। টাকা পয়সা লেনদেনের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত