পিতা পুত্রের স্বাধীনতা

সিকদার মনজিলুর রহমান

আপডেট : ০৯:২০ পিএম, রোববার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৯ | ১১৬৫

পিন্টুর মনটা আজ বেজায় খারাপ।

বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর মায়ের ঘর-গেরস্থালি সব শিকেয় উঠেছে। রাতদিন শুধু সে বাবার শোকে বিলাপ করে, আর মূর্ছা যায়। রান্না-বান্নাও ঠিকমতো করছে না। তাই গত রাতের কয়টা বাসী পান্তা খেয়েছে কাঁচা মরিচ আর চিংড়ি মাছের ভর্তা দিয়ে। এখন বেলা গড়িয়ে দুপুর। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। স্কুলে একবার যেতে চেয়েছিল কিন্তু যায়নি। যেয়েই বা কী হবে? ক্লাস তো ঠিকমতো হয় না। স্কুলে আসার পথে নিতাই স্যারকে নাকি রাজাকারেরা ধরে নিয়ে গেছে। পিন্টুর মাথায় ঢোকে না এই রাজাকার জিনিসটা কী? রূপ কাহিনির গল্পে শোনা রাক্ষস-খোক্ষস নাকি? এদের কী তলোয়ারের মতো বড় বড় দাঁত আছে? এক কামড়ে ঘাড় মটকে দেয়? রক্ত খায়?
পিন্টুর এই সব প্রশ্নের উত্তর কেউ দেয় না। দেবে কে? কাকে জিজ্ঞেস করবে? বাবাকে? বাবা তো বাড়িতে নাই, দৌলতপুরে। কবে আসবে কে জানে? সকালে পান্তা খেয়ে গেছে জামালদের বাড়ি। জামালের সাথে কাঁচের বল খেলছে, ঘরের পেছনে। সাথে জামালের বোন জলিও আছে। জামাল আর পিন্টু সহপাঠী। জলি পড়ে তাদের এক ক্লাস নিচে। কাচের বল খেলতে খুব পছন্দ পিন্টুর। সিকদার পাড়া, হাজরা পাড়ার কেউ পারে না তার সাথে কাচের বল খেলায়। কিন্তু আজ সে হেরে যাচ্ছে। যতবার বলে তাক করে মেরেছে, ততবারই ব্যর্থ হয়েছে।
- ঘটনা কী? তোর আজ কী হয়েছেরে পিন্টু? পিন্টুর এই হেরে যাওয়া দেখে জিজ্ঞেস করে বিজয়ী জামাল।
- কী ঘটনা?
- তুই বল ঠিকমতো মারতে পারতেছিস না কেন? তুই তো এ রকম ছিলি না।
- আসলে আমার মন ভালো না রে… পিন্টুর কণ্ঠে শোকের ছায়া।
ওর কণ্ঠের শোকে বল মাটিতে রেখে কাছে আসে জামাল, কেন কী হয়েছে তোর?
পিন্টু হাজরাপাড়ার জলিল হাজরার ছেলে। এলাকার সবচেয়ে চটপটে বালক। যেকোনো কাজে সে থাকে সবার আগে। তৈয়ব চাচার বাগানের গোলাপজাম পাড়তে হবে, মোল্লাবাড়ির জলপাইগাছ থেকে জলপাই খেতে হবে, নো চিন্তা ডু ফুর্তি, চলো। সবার আগে, সব কাজে পিন্টু। সেই দুরন্ত পিন্টু আজ এমন শান্ত কেন?
- আমার বাবার কোনো খবর নাই বলে কেঁদে ফেলে পিন্টু।
জামাল আর জলি বুঝে ফেলে, কেন দুরন্ত পিন্টুর কণ্ঠে আজ শোকের ছায়া। খেলার পরিবেশটাই খাটা হয়ে গেল। ওরাও জানে দেশের পরিস্থিতি ভালো না। নিজেদের গ্রামে নিজেরা ঠিকমতো খেলতেও পারছে না। কচুয়া সদরে সিও অফিসে পাকসেনা-রাজাকারেরা ক্যাম্প গেড়েছে। সেই ক্যাম্পের সামনে দিয়ে আসার সময় নিতাই স্যারকে রাজাকারেরা ধরে নিয়ে গেছে। ক্যাম্প থেকে যখন-তখন সৈন্যরা বের হয়ে যাকে সামনে পায় গুলি করে। মানুষগুলো মরে মাটিতে পড়ে গেলে পাকিস্তানি সৈন্যরা কাছে গিয়ে রাইফেলের বেয়োনেট দিয়ে লুঙ্গি তুলে উল্টে-পাল্টে দেখে, এই মাত্র মেরে ফেলা মানুষগুলো হিন্দু না মুসলমান?
- পিন্টু, তোরে আর কী কই ভাই? আমাদের বাড়ির অবস্থাও ভালো না। পিন্টুর কাঁধে হাত রাখে জামাল।
- কেন তোদের আবার কী হয়েছে?
- আমার মামা বাগেরহাট পিসি কলেজের প্রফেসর।
- ওই যে একবার নতুন মোটরসাইকেল নিয়ে আসছিল। সেই মামা?
- এই তো তোর মনে পড়ছে।
- আমাদের সে সাইকেলে চড়িয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরালো না?
তোর দেখি সব মনে আছে।
- মনে থাকবে না কেন?
- সেই মামাকে পাকিস্তানি আর্মি ধরে নিয়ে গেছে।
- তাই? আঁতকে ওঠে পিন্টু।
হ্যাঁ, চোখে পানি টল টল করে জামালের। মামার শোকে মা দিন-রাত শুধু কাঁদে, আর কাঁদে। মামার বিয়ের জন্য মেয়ে ঠিক করেছিল গোপালপুরে। সামনের মাসে তার বিয়ে হওয়ার কথা।
- আহারে… চুক চুক করে দুঃখ প্রকাশ করে পিন্টু। দেশে যে কি হলো- বুঝতেছি না। কোথায় পাকিস্তান, আর কোথায় আমাদের দেশ। পাইক্যারা কেন যে এই দেশে এল। কেন আমাদের মা-বোনেরা চোখের জলে ভাসে, কিছু বুঝি না রে।
- জলি? তুই বাড়ি যা বোন। গিয়ে দেখ মা আবার কী করছে বলল, জামাল।
- ভালো কথা মনে করছ ভাইয়া। আমি যাই বলতে বলতে জলি বাড়ির দিকে দৌড় দেয়। জলি চলে যাওয়ার পর জামাল আর পিন্টু দু হাতে কাচের বল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। পাশের বলেশ্বর নদী দিয়ে গানবোট যাওয়ার শব্দ শুনে জামাল উঠে দাঁড়ায়।
দাঁড়াস না, দাঁড়াস না। জামালের হাত ধরে নিচে টেনে বসায় পিন্টু।
- কী হয়েছে? আমাকে টেনে নিচে বসালি কেন?
- গানবোটে কারা চলে জানিস?
- কারা?
- পাকিস্তানিরা। আমাদের ক্লাসের খোকনের কাছে শুনেছি। গানবোটে পাকিস্তানি সৈন্যরা অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকে, বাঙালি দেখলেই গুলি ছোড়ে। সে জন্যই তোরে বসতে বলেছি।
- ভালো করেছিস। এখন বল তোর বাবার কী হয়েছে?
- বাবার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
- কেমনে জানলি?
- বাবার সাথে পাশের বাড়ির মন্টুও চাকরি করত দৌলতপুর আকিজ উদ্দিন জুট মিলে। সে বলল, বাবা গত সপ্তায় বেতন নিয়ে বাড়ি আসছেন। কিন্তু তিনি তো বাড়ি আসেন নাই। গেল কোথায়? মন্টু চাকরি ছেড়ে পালাইয়া বাড়ি এসে এসব ঘটনা জানাল। তারপর মা শুধু কাঁদে আর হুঁশ হারায়।
- খুবই খারাপ খবর। এখন কী করবি?
- আমি কী করব? মাথায় কিছু ঢোকে না।
- আমার মাথায়ও কিছু আসে না। পিন্টু, এক কাজ করা যায়, করবি?
- কী কাজ?
- রাতে আমার বাবা আর দাদা ফিসফিস করে বলাবলি করছে, তারা মনে করছে আমি ঘুমায়ে পড়ছি। আসলে আমি ঘুমাই নাই।
- কী বলাবলি করছে?
- ওই পাড়ার বদর চাচা নাকি মুক্তিযোদ্ধা।
- মুক্তিযোদ্ধা? সে আবার কী?
- মুক্তিযোদ্ধারা মিলিটারি আর রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
- সত্যি?
- হ্যাঁ, সত্যিই। তাহলে এক কাজ কর।
- কী?
- আমরাও বদর চাচার সাথে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিই। তারপর একদিন চাচারে সাথে নিয়ে তোর বাবা আর আমার মামারে খুঁজে বের করি।
- আমারও খুব ইচ্ছা হয়, দৌলতপুরে গিয়ে বাবারে খুঁজে নিয়ে আসি। মা সারা দিন শুধু বাবার জন্য বিলাপ করে, বাবার জন্য আমারও খুব কষ্ট হয়। আজ আর খেলব না, চল বাড়ি যাই।
পিন্টু আর জামাল এক সময়ে বাড়ি ফিরে যায়। দুজনে মায়ের মলিন ক্লান্ত আর কান্নাকাতর মুখ দেখে। পিন্টু বাড়ি গিয়ে দেখে মা কাঁদছে। বুকে জড়িয়ে আছে বাবার পুরোনো জামা-কাপড়। কাঁদছে ইনিয়ে-বিনিয়ে কারবালার শোকে- তুমি কই গেলা গো… আমি ছেলে-মেয়েদের কী কই…।
মায়ের পেছনে উঠোনে তিন বছরের বোন মিলি আপন মনে খেলছে পাশের বাড়ির কোহিনুরের সঙ্গে। মিলি জানেও না, তার বাবা আর আসবে না। পিন্টু ধন্দে পড়ে- সত্যিই কী বাবা আর আসবে না? বাবা না এলে কে খাতা-পেনসিল, জামা-জুতা কিনে দেবে? ঈদে নতুন জামা-কাপড় কে দেবে? বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। পিন্টু জানে, বাবা দৌলতপুর যায় লঞ্চে। সকাল ১০টায় একটা লঞ্চ স্বরূপকাঠি থেকে কচুয়ায় আসে। সেই লঞ্চে বাগেরহাট হয়ে রেলগাড়িতে দৌলতপুর যায়। বাবার সঙ্গে সে কয়েকবার দৌলতপুর গিয়েছে রাস্তাঘাট চিনতে কোনো অসুবিধা হবে না। কাল সকালেই সে দৌলতপুর যাবে।
খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠে পিন্টু। পুকুর ঘাটে হাত-মুখ ধুয়ে সোজা রান্নাঘরে ঢোকে। রান্নাঘরের পাটাতনে মাটির বয়ামে রাখা মুড়ি থেকে কিছু মুড়ি, সাথে এক হালি কলা একটা পলিথিনের ব্যাগে পুরে সেখান থেকে বের হয়ে ঘরে ঢোকে। ঘর থেকে বাবার পছন্দের হলুদ রঙের জামাটা গায়ে দিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়। দরজার পাশ দিয়ে উঁকি মেরে দেখে- মা ঘরের কোনে বসে ঝুঁকে ঝুঁকে কোরআন পড়ছে, আর মাঝে মাঝে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছে। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘর পার হয়ে বাড়ির বাইরে আসে। বাইরে এসেই দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করে। লঞ্চ আসার আগেই ঘাটে পৌঁছতে হবে। লঞ্চে উঠে বাগেরহাট। সেখান থেকে রেলগাড়ি চেপে দৌলতপুর। দৌলতপুর রেলস্টেশনের পাশেই আকিজ উদ্দিন জুট মিলস্‌।
কাছে থাকা ব্যাগ খুলে একটা কলা ও মুড়ি খেয়ে রাস্তার পাশের চাপকল থেকে পানি খায়। কিছু রাস্তা দৌড়ায়, একটু জিরিয়ে আবার হেঁটে এইভাবে চার মাইল রাস্তা পার হয় পিন্টু।
সামনে লাল-সাদা বড় বড় দালান, সিও অফিস। ওই দালান পার হলেই লঞ্চঘাট; স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পিন্টু। পরক্ষণে আবার আতঙ্ক চেপে ধরে তাকে। এই সিও অফিসই তো বর্তমানে রাজাকার ক্যাম্প। এই ক্যাম্পের সামনে দিয়ে স্কুলে আসতেই নিতাই স্যারকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত তাঁর কোনো খোঁজ নেই। ভয়ে ভয়ে সন্তর্পণে ক্যাম্পের সামনের রাস্তা ধরে লঞ্চঘাটের দিকে আগায়। জনমানব শূন্য রাস্তা, কোথাও কেউ নেই। ক্যাম্পের সামনে দিয়ে যেতে যেতে, তার পথচলার সাড়া পেয়ে দেয়ালের ওপর বসে থাকা নাম না জানা এক পাখি মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। ভয়ে জড়সড় হয়ে মাটিতে বসে পড়ার অবস্থা। চলার গতি স্তব্ধ হয়ে গেল। এই বুঝি রাজাকারেরা তার মাথায় গুলি ছুড়বে। সংবিৎ ফিরে দেখে একটা পাখি উড়ে গেল। নিজের অজান্তে গায়ে চিমটি কেটে দেখে, না সে তো ঠিকই আছে। এইভাবে সন্তর্পণে সে কচুয়া লঞ্চঘাটে গিয়ে পৌঁছে। অবাক কাণ্ড, ঘাটে লোকজন নেই। মাস তিনেক আগেও এই লঞ্চঘাটে এসেছিল পিন্টু বাবাকে পৌঁছে দিতে। দেখেছে লঞ্চঘাট মানুষের ভিড়। মানুষগুলো গেছে কোথায়? মাঝির ঘাটে কয়েকটি টাবুরে নৌকা। মাঝিরা অলস বসে আছে। পিন্টু আরও দেখে- কচুয়া বাজারেও তেমন লোক নেই। মাছের বাজারে দুজন লোক বসে আছে মাছ নিয়ে। কিন্তু কেনার খদ্দের কই?
হঠাৎ একটা লোক বাজারের ভেতর দিয়ে আসে। পিন্টুকে দেখে একটু অবাক হয় লোকটি। সে জিজ্ঞেস করে, তুমি কোথায় যাবে খোকা?
- দৌলতপুরে।
লোকটি আরও অবাক, তুমি দৌলতপুর যাবে কেন?
- সেখানে আমার বাবা চাকরি করেন। তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মা রাতদিন শুধু বাবার শোকে কান্নাকাটি করেন। আমি বাবার খোঁজে যাব।
লোকটি কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে, বাবা তুমি কেমনে দৌলতপুর যাবে?
- লঞ্চে যাব।
- লঞ্চ তো আজ তিন-চার দিন ধরে আসে না।
- কেন?
- কেমনে আসবে। লঞ্চ দেখলেই মিলিটারি, আর রাজাকারেরা যাত্রী নামায়ে দিয়ে লঞ্চ নিয়ে যায়।
- কোথায়?
- কোথায় আর যাবে, যায় বাঙালি মারতে। তুমি যেতে পারবে না, বাড়ি যাও। তোমাকে না পেলে মা আরও কাঁদবে, আরও দুঃখ পাবে। বলতে বলতে লোকটি পিন্টু যেদিক থেকে আসছিল ওই দিকেই রওনা দিল।
লঞ্চ আসার কোনো লক্ষণ না দেখে অগত্যা পিন্টুও লোকটার পিছে পিছে হাঁটতে শুরু করে। ছেলেটা এই দিকে আসছে দেখে লোকটাও তার চলার গতি শ্লথ করে পিন্টুর জন্য অপেক্ষা করল। পিন্টু কাছে যেতেই সে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী বাবা?
- আমার নাম পিন্টু।
- তোমার বাবার নাম?
- জলিল হাজরা।
- বল কী? তুমি জলিলের ছেলে?
- আপনি আমার বাবাকে চেনেন?
- চিনি মানে? আমাদের বাড়ি তো ওই দিকেই, হিন্দুপাড়া। তা ছাড়া তোমার বাবা, আর আমি একই সাথে কচুয়া হাইস্কুলে পড়েছি। হায়, হায় তুমি জলিলের ছেলে। লোকটা খুবই আফসোস প্রকাশ করল।
- আপনাকেও আমি কোথায় যেন দেখেছি। ঠিক মেলাতে পারছি না। আপনি কি আমাদের স্কুলে কোনো অনুষ্ঠানে আসছিলেন? যে অনুষ্ঠানে আমাদের স্কুলের ক্লাস ফাইভের ছাত্রী শেফালি মণ্ডল একটি গান গেয়েছিল।
- বাহ্‌, তোমার তো আজও মনে আছে।
- মনে থাকবে না কেন? তার গান শুনে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি থানা শিক্ষা অফিসার পর্যন্ত উঠে দাঁড়িয়ে তালি দিয়েছিল। আপনিই তো তবলা বাজিয়েছিলেন, তাই না?
- হ্যাঁ, বাজিয়েছিলাম। সেই শেফালি মণ্ডল আমার মেয়ে। আমার নাম সুভাষ মণ্ডল।
- তাই! কিন্তু...
- কিন্তু কী?
- সেদিন যে আপনাকে দেখেছিলাম প্যান্ট-শার্ট পরা, আর দাঁড়ি ছিল না। আর আজকে পায়জামা-পাঞ্জাবি মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। মাদ্রাসার মৌলভি সা’ব না হলেও পাক্কা মুসলমান।
- সবই পরিস্থিতির শিকার। আসল ছেড়ে এই নকল বেশভূষায় না চললে এত দিনে পাকি আর্মি কিংবা রাজাকারদের খোরাক হয়ে যেতাম। পরিবেশ বুঝে মাথায় গোল টুপিও পরি বলে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা টুপি বের করে দেখালেন তিনি। এই দেখ টুপি।
টুপি দেখে পিন্টু মুচকি হাসল। গত এক সপ্তায় এটাই তার প্রথম হাসি। এর পর সে বলল, কাকা?
- বলো।
- আমার একটা প্রশ্ন মাথায় আসছে?
- কী প্রশ্ন বাবা?
- আমার বাবাও তো প্যান্ট-শার্ট পরেন। প্রথম দেখে কে বুঝবে হিন্দু না মুসলমান। আমাদের প্রতিবেশী মন্টু তো বলেছে, বাবা বেতন নিয়ে বাড়ি আসছেন। তা হলে ওই ক্যাম্পের সামনে দিয়ে বাড়ি ফিরতে রাজাকারেরা কি তাকে ধরে নিয়ে গেছে?
- আমি তো জানি না বাবা। হলে হতেও পারে।
এইভাবে কথায় কথায় হাঁটত হাঁটতে পিন্টু আর সুভাষ মণ্ডল কচুয়া লঞ্চঘাট ছেড়ে ভৈরব ও বলেশ্বরের মোহনায় ব-দ্বীপের দিকে তাকায়, ওখানে অত মানুষ কেন? কী দেখে? সুভাষ মণ্ডল পিন্টুকে ছেড়ে নদীর ভিড়ের দিকে যায়। পিন্টুও পায়ের ওপর ভর দিয়ে তাকায়। দেখে মানুষজন নদীতে কি যেন দেখছে। সুভাষের পিছু পিছু সেও যায়। কাছে যাওয়ার পর দেখে, একেবারে তীর ঘেঁষে বেশ কয়েকটি লাশ। মানুষগুলো সেই লাশ দেখছে।
- বুঝলে ওই যে তিনটা লাশ দেখছ, ওই লাশগুলো হলো মেয়ে মানুষের লাশ। একজন বয়স্ক মানুষ মন্তব্য করে।
- তাই নাকি? আর একজন প্রশ্ন করে, করিম চাচা আপনি কেমনে বুঝলেন?
- মেয়ে মানুষের লাশ পানিতে উপুড় হয়ে ভাসে।
আর একজন দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে- হে মাবুদ!
পিন্টু দেখে আর গোনে, এগারোটা লাশ। তিনটা লাশ উপুড় হয়ে আছে। বাকি লাশগুলো চিৎ। অনেকের মাথার অর্ধেক নেই। কারও বা পেটের অর্ধেক নেই। কোনো লাশ প্রায় তাজা। পরনে প্যান্ট আছে। একটা লাশের একটা পায়ে বুট জুতো আছে, অন্য পা খালি । জুতা দেখে আঁতকে ওঠে পিন্টু। ওই রকম এক জোড়া বুট জুতা তার বাবারও ছিল।
- আহারে! এত অত্যাচার আল্লায় সহ্য করবে না। সহ্য করবে না- বলতে বলতে কাঁধের গামছায় চোখ মোছে করিম চাচা।
- আরে চাচা আস্তে বলেন এক যুবক বৃদ্ধকে বলছে। আশপাশে কে না কে আছে, কে জানে। যদি তাদের জানায়ে দেয়?
- বাবারে, আমিতো মরতে বসেছি, বয়স তো কম হয় নাই। মারলে আমাকে মারুক। আর সহ্য হয় না। প্রতিদিন এই বলেশ্বর দিয়ে কত শত লাশ ভেসে যায়। লাশগুলো কাক-পক্ষীতে খায়। তারা তো আমাদের দেশেরই মানুষ। তাদের জন্য আমাদের অন্তর পোড়ে না?
-সবই বুঝি চাচা কিন্তু কী করব বলেন?
করিম চাচার কথা শেষ হতে পারে না আরেক যুবক বলে- ভাসতে ভাসতে লাশগুলো এক সময় অচিন দেশের কোনো এক নদীর চরে গিয়ে ওঠে। আর এদের কবর হয় শিয়াল শকুনের পেটে। প্রতিদিন এই রকম কত শত লাশ ভেসে যায়। শুধু চোখ দিয়ে দেখি, আর মনের দুঃখে কাঁদি। দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না। এই লাশগুলো তুলে যে দাফন-কাফন করব, সে সৎসাহসও নাই।
- কী পোড়া কপাল। দেশের মাটিও তারা পায় না। মৃত্যুর পরে জানাজাও হয় না, শ্মশানেও নেয় না। আবার কান্নার শব্দ করে করিম চাচা। কান্না একটু থামলে পর চাচা বলেন, মিয়ারা, তোমরা যে যার অজু করে আস।
- একজন জিজ্ঞেস করল, অজু কেন?
- আস আমরা সবে মিলে এঁদের গায়েবানা জানাজা পড়ি।
নদীর চরে নেমে কেউ অজু করল, কেউ করল না। সবার সাথে পিন্টু ও সুভাষ মণ্ডলও জানাজায় দাঁড়িয়ে গেল। জানাজা শেষে আসমানে হাত তোলে করিম চাচা। সঙ্গে সঙ্গে সবাই হাত তোলে। বিষণ্ন গলায় করিম চাচা মোনাজাত করেন, ‘হে আল্লাহ পরোয়ারদেগার, যারা আমাদের দেশের এই নিরীহ মা-বোন-ভাইদের মারছে, তাদের বিচার তুমি করবেই করবে। আমি যদি এক ওয়াক্ত নামাজও পড়ে থাকি, আমার মোনাজাত তুমি কবুল করবেই করবে। আর দেশের এই মানুষগুলোরে তুমি বেহেশতে স্থান দেবে। আর যেন এমন লাশ দেখতে না হয়। তুমি পরওয়ারদিগার, রহমানের রাহিম, তুমি আমাদের এই ফেরাউনের বংশধর পাক-রাজাকারদের হাত থেকে রক্ষা কর, রক্ষা কর মাবুদ। আমিন, আমিন।’ সবাই উচ্চ স্বরে বলে আমিন।
বৃদ্ধ করিম চাচা শিশুর মতো কাঁদতে থাকেন। অনেকে তাঁর সাথে কাঁদে। পিন্টুও কাঁদে তাদের সাথে। মোনাজাত শেষে যে যার মতো দ্রুত চলে যায়। পিন্টু জানে না, নদীর জলে ভেসে যাওয়া এই এগারোজনের লাশের ভেতরে এক পায়ে বুট জুতা পিন্টুর বাবা জলিলের লাশও আছে কিনা। তাকে চেনার উপায় নেই। পুরো শরীর ফুলে ঢোল। চোখ-মুখ বিকৃত। বুকের অনেকখানি অংশ কাকে খেয়েছে।
বাড়ির একেবারে কাছ দিয়ে জলিল ভেসে যাচ্ছে জীবনের বিদায় বন্দরে। যে বন্দর থেকে সে আর কোনদিন ফিরবে না প্রিয়ভূমি হাজরাপাড়ার লোকালয়ে। যে পুত্র একাই বাড়ি থেকে বের হয়েছে তার সন্ধানে, তার চোখের সামনে দিয়ে নদীর ঢেউয়ে দুলতে দুলতে জলিলের লাশ ছুটে চলছে ভাটির টানে। পিতা-পুত্র কেউ কাউকে চিনল না।

লেখকঃ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী

প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কচুয়া প্রেস ক্লাব

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত