বিজয়পুরের মেয়ে

সিকদার মনজিলুর রহমান

আপডেট : ০৪:০৩ পিএম, শনিবার, ২৩ মার্চ ২০১৯ | ২৪৬৩

বদরগঞ্জ। এক ষ্টেশন পরেই রংপুর। সেই বদরগঞ্জ রেলওয়ে ষ্টেশনের ষ্টেশন মাষ্টার আব্দুল আলীম। আদি বাড়ি বাগেরহাটের বিজয়পুর গ্রামে । এক যুগেরও বেশী চাকরি করছেন বাংলাদেশ রেলওয়েতে । গত এক বছর ধরে আছেন বদরগঞ্জ রেলওয়ে ষ্টেশনে,ষ্টেশন মাষ্টারের দায়িত্বে। বাসা ষ্টেশনেরই কাছে রেলওয়ে কলোনীতে । হাফিজ, শিমুল ও পলাশ এই তিন সন্তানের সুখী সংসার আলীম দম্পতীর। বড় ছেলে হাফিজ রংপুর কারমাইকেল কলেজ, বড় মেয়ে শিমুল রংপুর মেডিকেল কলেজ আর ছোট মেয়ে পলাশ বদরগঞ্জ গার্লস হাই স্কুলে পড়ে। এবার এসএসসি পরীক্ষা দিবে।

খাবার টেবিলে বসে সকালের নাস্তা করছিলেন আব্দুল আলীম। পাশের চেয়ারে বসে আছেন স্ত্রী উম্মে হাবিবা। খাওয়া শেষ হওয়ার আগমূহুর্তে প্রতিদিন চা দিয়ে যায় শিমুল । মাঝে মধ্যে পলাশও এ কাজটি করে থাকে । তবে শিমুলের হাতের চা বাবার খুব পছন্দ ।

প্রতিদিন সকাল সাড়ে ন’টায় বদরগঞ্জে একটি ট্রেন আসে দিনাজপুর থেকে। ট্রেনটি যায় রংপুর হয়ে লালমনিরহাট । এই ট্রেনেই কলেজে যায় দুইভাই বোন হাফিজ ও শিমুল । হাফিজ কারমাইকেলে এবং শিমুল যায় রংপুর মেডিকেল কলেজে। কলেজে যাবার পূর্বে বাবাকে চা বানিয়ে দেয়া শিমুলের একটা রোজ নামচারই অংশ। আজকে বাবার জন্য চা নিয়ে এলো পলাশ। পলাশকে চা আনতে দেখে বাবা আব্দুল আলীম স্ত্রী হাবিবাকে জিজ্ঞেস করলেন ,”বেলা ন’টা বেজে গেল ওরা এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি ট্রেনতো এখনই এসে পড়বে ?”

টের পেলাম হাফিজ উঠেছে । শিমুল বলছিল ওদের কলেজ গেটে নাকি গতকাল ক’টা বাঙালি ছেলে একটা বিহারী ছেলেকে পিটিয়েছে। তার জের ধরে আজকেও বাঙালি বিহারীর মধ্যে কোন সংঘর্ষ বাঁধতে পারে ? তাই বলছিল আজকে সে কলেজে যাবে না, জবাব দিলেন হাবিবা ।

তাই নাকি ? দেশের রাজনৈতিক যে দূরাবস্থা জানি না কি হয় ?

মায়ের কথা শুনে বাবার টেবিলে চা রেখেই লাফাতে লাফাতে পলাশ শিমুলের রুমে গেল । শিমুল কেবল বিছানা ছেড়ে টুথ ব্রাসে পেষ্ট লাগিয়ে দাতঁ ব্রাস করতে করতে বাথ রুমের দিকে যাচ্ছিল।

তাকে সামনে পেয়েই পলাশ শিমুলকে জিজ্ঞেস করল ;আপু ” তুই নাকি আজকে কলেজে যাবি না ? আমাদের স্কুলে আজ একটা অনুষ্ঠান আছে । আমাদের পরীক্ষার্থীদের বিদায় সংবর্ধনা। সেখানে অনেকের মা বাবা, ভাই বোন আসবে । বাবাকে বললাম তিনি যেতে পারবেন না । মাকে বললাম তিনিও যাবেন না। তুই তো আজ কলেজ যাচ্ছিস নে চলনা আমার সাথে। ”

সকালের নাস্তা খেয়ে দুইবোন অনুষ্ঠানে পৌঁছিল। অনুষ্ঠানে নাচ গান কৌতুক কবিতা আবৃতি অনেকে অনেক কিছু উপস্থাপন করল । কিছুক্ষণ পর ঘোষণা এলো, সূধী মন্ডলী এবার আপনাদের সামনে সঙ্গীত পরিবেশন করবেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ছাত্র মোহাম্মদ হাসান জাহিদ ।

পল্লী গানের বিখ্যাত শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের গাওয়া সেই বিখ্যাত গান,’‘আমায় এত রাতে কেন ডাক দিলি প্রাণ কোকিলা রে ‘ গানটি গেয়ে দর্শক শ্রোতাদের মন কেড়ে নিল। গান শুনে শ্রোতা দর্শক মুহু মুহু করতালিতে হল কাঁপিয়ে তুলল। অনেকে মন্তব্য করল কন্ঠ যেন অবিকল আব্বাস উদ্দিন। শ্রোতাদের অনুরোধে আরও দু’টো গান পরিবেশন করল।

অনুষ্ঠান শেষে শিমুল পলাশ দু’বোন বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে আছে রিকশার অপেক্ষায় এমন সময় হাসানও বেরিয়েছে স্কুল থেকে। হাসান শিমুলের মুখোমুখি হতেই শিমুল তাকে জিজ্ঞেস করল,আপনি রংপুর মেডিকেল কলেজে পড়েন বুঝি ?

একটি সুন্দরী মেয়ের হঠাৎ এমন প্রশ্নে হাসান প্রথমে থতমত খেয়ে গেল। নিজেকে সামলায়ে জবাব দিল হ্যাঁ । সেও পাল্টা প্রশ্ন করল কেন বলুন তো ?

না মানে, আমিও ওখানে পড়ি কিনা । গতকাল বিকালে ক্লাশ থেকে ফেরার পথে কলেজ গেটে যে গন্ডগোলটা দেখলাম মনে হয় আমি আপনাকে সেখানে দেখেছি ?

ও তাই বুঝি ? আপনি কোন ইয়ারে ?

ফার্ষ্ট ইয়ারে ।

আমি সেকেন্ড ইয়ারে । আমরাই তো মেডিকেলের প্রথম ব্যাচ।

সত্যিই চমৎকার গেয়েছেন। আপনার গান শুনে হল ভর্তি মানুষে কি ভাবে উজ্জীবিত হয়ে হলটাকে মাতিয়ে তুলল । অপূর্ব গান আপনি ।

গান সে মাঝে মধ্যে স্কুল কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেয়ে থাকে । সামনাসামনি কোন মেয়ে মানুষের কাছে এমন প্রশংসা এই প্রথম । এমন প্রশংসায় সে যেন একটু আবেগে আপ্লুত হয়ে হারিয়ে গেল অন্য জগতে ।

তার সে ভাবটা যেন শিমুল টের পেয়ে গেল । সে আবেগ থেকে স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে সে তাকে জিজ্ঞেস করল ,” আচ্ছা ,গতকালকের ঘটনাটা কি ? ”

আর বলবেন না। শালা বিহারীর বাচ্চা, পাকিস্তানী দালাল। বলে কিনা, ”হাতমে ছড়ি মুমে পান,লড়কে লেংয়ে পাকিস্তান। ” আমাদের সাথেই পড়ে । নইলে দিতাম পাঠিয়ে একেবারে গোরস্থান ।

আপনি এই দিকে থাকেন বুঝি ?

জ্বী। আমার ছোট বোন এবার এসএসসি দিচ্ছে। ওর নাম পলাশ।

পলাশ এ সময়ে স্কুল চত্বরে একটি কাঁঠাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ক’জন মেয়ের সাথে গল্প করছিল । সে দিকে তর্জনী উঁচিয়ে দেখাল ঐ যে কাঠাঁল তলে ক’জন মেয়ে গল্প করছে আসমানী রং এর কামিজ আর সাদা শালওয়ার পড়া মেয়েটি আমার বোন, পলাশ ।

ও আচ্ছা। আপনাদের বাসা তাহলে এখানে ?

জ্বী, রেলওয়ে কলোনীতে আমাদের বাসা । বাবা এখানের রেলওয়ে ষ্টেশনের ষ্টেশন মাষ্টার ।

আপনাদের বাসাও কি এখানে ?

না । আমাদের বাসা রংপুর , আলম নগর । মামা বাড়ি এখানে । মামাত বোন পরীক্ষা দিচ্ছে । মামিমা বললেন চল, হাসান বিদায় সংবর্ধনা দেখে আসি। তাই আসলাম ।

কী নাম আপনার বাবার ?

আব্দুল আলীম।

হাসান বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, আব্দুল আলীম ? আপনারা কি এর পূর্বে সৈয়দপুর ছিলেন?

জ্বী।

বলেন কী ? আপনার ভাইয়ের নাম কি হাফিজ ?

আপনি আমার ভাইয়াকে চেনেন ?

চিনি মানে, আমরা তো এক সময়ে বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম। আপনাদের বাসা ছিল রেলওয়ে মাঠের পূর্ব দিকে আতিয়ার কলোনী। আপনার বাবা তখন সৈয়দপুর ষ্টেশনের সহকারী ষ্টেশন মাষ্টার । কী ঠিক বলিনি ?

ও মাই গডস্ ! আপনি দেখি আমাদের পরিবারের আদ্যোপান্ত জানেন ।

আমি তখন আলম নগর হাই স্কুলে ক্লাস টেনের ছাত্র । একবার স্কাউট ক্যাম্পিংএ গিয়েছিলাম সৈয়দপুর । আমাদের ক্যাম্পিংটি ছিল রেলওয়ে মাঠে । আমাদের স্কুলের দলপ্রধান ছিলাম আমি আর সৈয়দপুর রেলওয়ে হাই স্কুলের আপনার ভাই হাফিজ । সে সময়ে হাফিজের সাথে রেল লাইন পাড় হয়ে মাঝে মাঝে আপনাদের বাসায় যেতাম । সে তো রংপুর কারমাইকেলে পড়ছে তাই না ? অনেক দিন পর্যন্ত আমাদের মধ্যে চিঠিপত্রের যোগাযোগ ছিল। হঠাৎ জানি কবে তা বন্দ হয়ে গেল । হাফিজকে আমার কথা বলবে তো ? এই যা , আপনাকে আমি তুমি বলে ফেললাম।

শিমুল হেসে বলল, ঠিক আছে । আপনি তো আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু । তাছাড়া বয়সেও বড় । আপনি না বলে তুমি বলা

অযৌতিক নয় ।

এমন সময় হাসানের মামি ও মামাত বোন স্কুল থেকে বেরিয়ে এলো । মামি বললেন ,” কিরে চ্যাংরা তুই এইখান বসি গল্পে আছিস আর হামরা তোমাক সারা ইস্কুল খুঁজি বেরি । হাঁটো বাহে বাড়িত যাই।”

মুইও খুঁজি বেরি তোমাক না পাই গেটোত আসি দাঁড়ায় আছো । মামিমা তারার নাম শিমুল। হামার ইস্কুল লাইফের বন্ধু হাফিজের বইন।

মামি শিমুলের দিকে তাকিয়ে বলল তাই ? তোমাদের বাসা এখানে বুঝি ?

হ্যাঁ, চলেন আমাদের বাসা থেকে বেড়িয়ে যাবেন ।

না আরেক দিন যাব ।

মামিকে উদ্দেশ্য করে হাসান বলল, মামিমা, তোরা রিকশাত চড়ি বাড়িত যান। মুই টাউন থাকি একটু বেরি আসি। ”
মামি ও মামাত বোনকে একটি রিকশা ঠিক করে দিয়ে সে নিজের মোটর সাইকেলের গিয়ারে চাপ দিল। সাইকেলটি ভো ভো করে উঠল। মূহুতে সে চোখের আড়াল হয়ে গেল। যাবার মূহুর্তে হাত নেড়ে শিমুলকে জানিয়ে গেল, আল্লাহ হাফিজ।‘

রংপুর আলম নগরের ছেলে হাসান জাহিদ। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সে সবার ছোট । বাবা জাহিদ আহমেদ তামাকের আড়ৎদার । হাসান বিড়ি নামে একটি বিড়ির ফ্যাক্টরীও আছে হারাগাছে।

১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের একক প্রতিনিধিত্ব লাভ করে। পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্ব তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করে । ১ মার্চ ১৯৭১ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনিষ্টকালের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দিল ।

সেদিন কলেজ থেকে বাসায় ফেরার জন্য রংপুর রেলওয়ে ষ্টেশনে হাফিজের অপেক্ষায় ওয়েটিং রুমে বসে আছে শিমুল । এমন সময় রং তুলি ও একগাদা পোষ্টারিং কাগজ বগল চাপা করে সেখানে উপস্থিত হলো হাফিজ।

এসব দেখে শিমুল তাকে জিজ্ঞেস করল ,ভাইয়া এসব কি ?

দেশের পরিস্থিতি ভাল না । এখানে বলা যাবে না। চল বাসায় গিয়ে বলব ।

”বঙ্গবন্ধুর বাণী সম্বলিত কিছু পোষ্টার এগুলো বিভিন্ন জায়গায় পোষ্টারিং করতে হবে । প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনিদিষ্টকালের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন । নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করছে । মনে হচ্ছে আন্দোলন ছাড়া এ সমস্যার সমাধান হবে না। এমন কি যুদ্ধবিগ্রহও বাধতে পারে । আগামিকাল মেডিকেলে হাসানের সাথে যদি দেখা হয় আমার সাথে দেখা করতে বলতে পারবি ? ”

দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে অনেক কথা হলো। হাফিজ হাসানকে বলল ,”শোন দোস্ত ,পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্টি দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে আমাদের পূর্ব পাকিস্তানকে শাসনের নামে শোষণ করে আসছে । তারা কথায় কথায় বলে আমরা মুসলমান। সব মুসলিম ভাই ভাই ।ওরা শুধু কথার ফুলঝুরি ছড়ায় । আসলে তারা চায় এ বাঙালি জাতিকে শাসনের নামে শোষণ করতে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিল এখন পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় দেয় বলা যায়না। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে যোগাযোগ রাখার অঙ্গীকারে সেদিনের আলোচনা মূলতবী হলো।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অনিদিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা দিলে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের জরুরী বৈঠকে ২ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করে । ৩ মার্চ সারা বাংলায় হরতাল পালিত হয় । নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তের জন্য বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্টেরর প্রতি আহবান জানান । ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষনে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্ততি নিতে দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান তিনি ।

বঙ্গবন্ধুর আহবানে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্ততি নিলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের টনক নড়ে। ১৬ মার্চ ক্ষমতা হস্তান্তরের এক প্রহসনমূলক বৈঠক ডাকে বঙ্গবন্ধুর সাথে ইয়াহিয়া খান। এ সময় জুলফিকার আলি ভুট্টোও উড়ে আসে করাচি থেকে ঢাকায় । ২৪ মার্চ পর্যন্ত এ প্রহসনের বৈঠক চলে । ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হবার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের ইঙ্গিত দিয়ে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন ।

২৫ মার্চ দিবাগত রাত্রে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের নেতৃত্বে পাক আর্মি ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ বাঙালিদের উপর। চালায় গণহত্যা লুটতরাজ হত্যাযজ্ঞ। গভীর রাতে কালুরঘাট বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা হয় । স্বাধীনতা ঘোষণা দেবার অপরাধ দেখিয়ে ঐ রাতেই তাকে তার ধানমন্ডীর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনা নিবাসে নিয়ে যায় । এবং সেখান থেকে তাকে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে ।

পাকবাহিনীর আক্রমণ ও গণহত্যা মোকাবেলার জন্য বাঙালিরা প্রতিরোধ গড়ে তুলল । পাক সেনারা সংখ্যায় অনেক ও তারা ছিল আধুনিক অস্ত্র সস্ত্রে সজ্জিত তাদের সস্ত্রের মুখে বাঙালিরা টিকে উঠতে পারলনা । ভারতের প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাঙালিদের সংগ্রামের প্রতি তাঁর সরকারের অকুন্ঠ সহানুভূতি জ্ঞাপন করে পূর্ব পাকিস্তান -ভারত সীমান্ত উম্মুক্ত করে দিল । অত্যাচারিত ও ভীতসন্ত্রস্ত বাঙালিরা দলে দলে সে দেশে যেতে লাগল । পশ্চিমবঙ্গ, বিহার,আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্যের সরকারগুলি সীমান্ত বরাবর শরণার্থী শিবির স্থাপন করল । এই শিবিরগুলো থেকেই বাঙালিরা তাদের প্রিয় মাতৃভূমি রক্ষায় মুক্তি যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে শুরু করল ।

বঙ্গবন্ধুর আহবানে স্কুল কলেজ অনিদিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে হাফিজ ও হাসান মহল্লার ক’জন যুবক এবং কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতৃ হাফিজদের বাসায় বৈঠক করল । সিদ্ধান্ত হলো তারা দিনাজপুরের ফুলবাড়ি সীমান্ত হয়ে ভারতে যাবে এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিবে । তাদের সাথে শিমুলও যোগ দেবার মনস্থির করলে হাফিজ তাতে আপত্তি করল ।

শিমুল বলল ভাইয়া,আমি বাড়ি বিজয়পুরের মেয়ে। বাগেরহাটের বিজয়পুর আমাদের বাড়ি।

বিজয়পুর তাতে কি হয়েছে ?

বিজয়পুরের মেয়েরা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় না।

শিমুলের কথা শুনে হাফিজ হেসে উঠল ।

হাফিজের হাসি দেখে শিমুল রেগে গিয়ে বলল তুমি হাসলে যে , ভাইয়া ? তা ছাড়া আমি একজন মেডিকেলের ছাত্রী । ডাক্তার না হলেও আমার মধ্যে ডাক্তারি বিদ্যেতো রয়েছে। তোমরা যুদ্ধ করবে রণাঙ্গনে আর কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি তাকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলব । আমার ডাক্তারি বিদ্যেটুকু দেশের কাজে ব্যবহার করতে চাই । তুমি আপত্তি করো না ভাইয়া আমাকেও তোমাদের সঙ্গে নিয়ে চলো। আর এখানে থাকলে আমাকেও অন্যান্যের মত পালিয়ে বেড়াতে হবে । পালিয়ে পালিয়ে বাচাঁনার চেয়ে দেশের সেবায় জীবন উৎসর্গ করে দেওয়াই উত্তম , ” আই ওট টু লাভ মাই কান্ট্রি । ”

এ সময়ে হাসান বলল,সি ইজ রাইট । যেতে চাচ্ছে যাক না ।

১৫/২০ জনের একটি দল ফুলবাড়ি সীমান্ত দিয়ে ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর পৌঁছিল । সেখানে বালুবাড়ি শরণার্থী শিবিরে তারা অবস্থান করল। সেখানে গিয়ে সন্ধ্যা রাণী নামের এক ক্লাসমেটের সাথে দেখা হলো শিমুলের । সন্ধ্যারাণী ও তার স্বামী সৌমিত্র যেয়ে পৌঁছেছে তার দু’দিন আগে । শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় বাসীদের জন্য একটা প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়েছে । চিকিৎসা কেন্দ্রের পরিচালিকা শ্রীমতি অঞ্জলী দেবী শিমুল ও সন্ধ্যারাণীকে পেয়ে খুবই খুশী হলেন । তিনি তাদের সেখানে যোগ দিতে বললেন। হাসান,হাফিজ ও অন্যান্যরা একটি আশ্রয় শিবিরে থেকে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগ দিল ।

বদরগঞ্জে হাফিজ শিমুলদের বাসায় তাদের মা বাবার টিকে থাকা দায় হয়ে পড়ল । তাদের বাসায় রাজাকার পাক সৈন্যরা কয়েকদফা লুটপাত করে তার মা বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে । বাসা ছেড়ে তারা ছোট বোন পলাশকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে পালিয়ে বেড়াতে লাগলো । অবশেষে চাকরি ছেড়ে পৈতৃক বাড়ি বিজয়পুর যাবার সিদ্ধান্ত নিল ।

কয়েক মাস প্রশিক্ষণ শেষে হাফিজ ও হাসান বীরদর্পে ফিরল দেশের মাটিতে । রংপুর ও দিনাজপুর জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে গঠিত ৬নং সেক্টরে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন উইং কমান্ডার এম কে বাশার । হাফিজ ও হাসান তার সেক্টরে যোগ দিল। সারা দেশে তখন মুক্তিযোদ্ধারা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে । প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ শেষে বাংলার দামাল ছেলেরা ততক্ষণে নিজ নিজ এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধে শত্রুদের উপর সর্বস্তরে ও সর্বোতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে । হাসান ও হাফিজ তাদের নিজ এলাকা বদরগঞ্জ ,চিলমারি তারাগঞ্জ চিকলী নদী প্রভৃতি অঞ্চলে শত্রু সৈন্যদের উপর ঝাপিয়ে পড়ছে। এলাকার রাজাকার পাকসেনারা হাসান হাফিজের নাম শুনলেই ভয়ে শিউরে উঠছে ।

হাফিজ ফিরে এসেছে রণাঙ্গনে আর শিমুল রয়ে গেছে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত পশ্চিম দিনাজপুরে শরণার্থী ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসা কেন্দ্রে । শিমুলের সেবায় বহু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সুস্থ হয়ে উঠেছে অনেকে আবারও রণঙ্গনে ফিরে এসেছে । দীর্ঘ ৮ মাস মা বাবা একমাত্র আ্দরের বোন পলাশকে রেখে দুইভাই বোন দেশের টানে দেশ ছেড়ে এ পরবাসে। কিছু দিন আগেও মাঝে মধ্যে ভাইয়ের সাথে দেখা হতো । আজ অনেকদিন হলো তা ও হচ্ছে না । সে আছে রণাঙ্গনে । মা বাবা আর ছোট বোনটার জন্যে মনটা অস্থির হয়ে উঠল শিমুলের। মাত্র কয়েক ঘন্টার দূরত্বে তাদের বাসা। কয়েক দিন ধরে অঞ্জলী দেবীকে বলে আসছে মাত্র দু’দিনের জন্য সে ছুটি নিয়ে মা বাবা ও বোনের সাথে একবার সাক্ষাত করেই সে ফিরে আসবে । তিনি কিছুতেই তাকে দিতে ছুটি দিতে রাজী হচ্ছেন না । উল্টো বলছেন, ”পূর্ব পাকিস্তানে চারিদিকে পাকসেনা আর রাজাকারদের আনাগোনা সে সেখানে গেলে আর ফিরে আসতে পারবে না। ” এত বিপদের আশংকা জেনেও মন মানে না শিমুলের । তার সঙ্গী হবার জন্য সন্ধ্যারাণী সহ অনেককেই অনুরোধ করেছে । কিন্তু কেউই তার সঙ্গী হতে রাজী হয়নি । অবশেষে অসীম সাহস বুকে নিয়ে এক রাতের আঁধারে শিবির থেকে একাই পালালো শিমুল । সে শিবির থেকে পালালে যুদ্ধরত তার ভাই হাফিজকে ওয়ারলেস মাধ্যমে জানানো হয় ।

নোংরা কাপড় আর বোরকা পড়ে বুড়ির বেশে ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর থেকে বাসে চড়ে সোজা ফুলবাড়ি সীমান্তে এসে নামল। ফুলবাড়ি থেকে পার্বতীপুর যাবে । সেখান থেকে বদরগঞ্জের সংযোগ ট্রেন পাওয়া যাবে। খুলনা থেকে ছেড়ে আসা চিলাহাটিগামি একটি ট্রেনে চেপে পার্বতীপুর পৌঁছিল।

ফুলবাড়ি ষ্টেশনে যখন ট্রেনের টিকিট নিচ্ছিল তখন দু’জন বিহারী মাহিলাও টিকিট নিচ্ছিল । মহিলা দু’জন বার বার তাকে অনুসরণ করছিলো । সে যখন ফুলবাড়ি থেকে ট্রেনে চড়ল মহিলারাও তার সাথে একই বগিতে চড়ে কাছাকাছি আসন নিল। শিমুল ট্রেনে বসলে নোংরা কাপড় আর বোরকার নিচ থেকে পায়ের নখের টুকটুকে লাল নেইল পলিশ আর ফুটফুটে পদযুগল বেরিয়ে পড়ল খানিকতা । সে লক্ষ্য করল তখন তারা তাকে নিয়ে নিজ ভাষায় বলাবলি করছে ,” ও আওরাতকো দেখনেকে বুরহী লাগতি হ্যায় ল্যাকিন ওসকি নেইল পলিস অর পাওছে লাগতা হ্যায় ও বুরহী নেহী । হো সাকতা হ্যায় ও কই মুখবর হো ? ” তাদের এ কানাঘুষা একসময়ে শিমুলের কানেও এসে পৌঁছিল ।

কানাঘুষা শুনে শিমুলের সন্দেহ হলো। এরা কি সাধারন যাত্রী নাকি গুপ্তচর ? শিমুল পার্বতীপুরে নেমে গেলে তারাও সেখানে নেমে গেল ।

পার্বতীপুর ষ্টেশনে বদরগঞ্জ ট্রেনের সংযোগ ট্রেনের অপেক্ষা করছিল শিমুল। এমন সময় হঠাৎ একজন আর্মি অফিসার এবং জন তিনেক রাজাকার এসে তাকে ঘিরে ফেলল। সে বুঝতে পারল ঐ মহিলা দু’জন কোন সাধারণ যাত্রী ছিলেন না। ছিলেন পাক আর্মির সোর্স বা গুপ্তচর । পাক আর্মির কাছে ধরা পড়ে গেল শিমুল ।

তাকে ক্যাম্পে নিয়েই বোরকা খুলে ফেলল । বোরকার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো এক সুন্দরী যুবতী । তাকে দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল ক্যাম্পের সদস্যরা । শুরু হলো মারধোর ,মাগি হিন্দুস্তানের দালাল, বল তোর মুক্তিরা কোথায়? বল বল তাদের আস্তানা কোথায় ?

আমাকে আর মেরো না আমি ছিলাম চিকিৎসা শিবিরে এক নার্স মাত্র তাদের সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। দুধে আলতা মাখা রং এর শরীর থেকে যেন রক্ত ফুটে ফুটে পড়ছে । মারের এক পর্যায়ে সে বেহুস হয়ে পড়ল । জ্ঞান ফিরলে তার উপর আবারও চলল উৎপীড়ন । কিন্তু তার কাছ থেকে তারা সে ছিল নার্স এ তথ্য ব্যতিত আর কোন তথ্য তারা পেল না। এক পযার্য়ে তাকে দিগম্বর করে ফেলল ।

এক রাজাকার বলল যা গোটা তিনেক ডিম সিদ্ধ করে নিয়ে আয় ।

আরেকজন জিজ্ঞেস করল,ওস্তাদ সিদ্ধ ডিম কি করবেন ? ওকে খেতে দিবেন ?

আরে শালা না। আগে আন তারপর দেখ । ও তো দূরের কথা ওর বাপ পর্যন্ত স্বীকার করবে সে কে ? সে স্বীকার করবে তার মুক্তি বাবারা কোথায় ? আরো জানবে পাকিস্তান ভাঙার পায়তারকারী হিন্দুস্তানের দালালদের কি পরিনাম ?

আমি বুঝেছি ডিম দিয়ে আপনি কি করবেন। না না ওস্তাদ ঐ কর্ম করা যাবে না ।

তোর দেখছি ছেরির জন্য ম্যালা দরদ । ব্যাপার কি ?

দরদ ওর জন্য না , দরদ আপনার জন্য ।

আমার জন্যে ক্যান ?

আজ রাতে ওকে তো ক্যাপটেন সাহেবের রুমে পাঠাতে হবে । জ্বলে পুড়ে ফোসকা পড়ে গেল ক্যাপটেন সাহেবের বিনোদনে ব্যাঘাত ঘটবে । আর তার বিনোদনে ব্যাঘাত ঘটলে আপনার খবর আছে ?

হাফিজ গুপ্তচরের মাধ্যমে খবর পেল পার্বতীপুর রেলওয়ে ষ্টেশনে তার বোন ধরা পড়েছে । কয়েক দিনপরে খোলাহাটি রেলওয়ে ষ্টেশনের কাছে একটা ডোবায় নারি পুরুষের অনেকগুলো ছিন্নভিন্ন লাশ আবিস্কার করেছে গ্রামবাসী । তাদের মধ্যে শিমুলের লাশও ছিল ।

দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটায় রমনা রেসকোর্সে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নিকট পাকিস্তান বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজী পাকিস্তান সরকারের পক্ষে আত্ম সমর্পণ করেন । নিয়াজীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটল । ভূমানচিত্রে জন্মনিল নতুন একটি দেশ , বাংলাদেশ ।

ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার অভিযোগে হাসানের বাবা জাহিদ আহমেদকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেছে পাকবাহিনী । তিনি আর বাড়িতে ফিরে আসেননি । সে সময় বাবাকে রক্ষা করতে যেয়ে মাও আহত হয়েছেন। আর হাফিজদের বাসায় তালা বন্ধ। কেউ তাদের সঠিক সন্ধান দিতে পারল না । অবশেষে দুই বন্ধু সিদ্ধান্ত নিল তাদের সন্ধানে দাদা বাড়ি বিজয়পুরে যাওয়ার। হয়তো সেখানে তাদের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে ?

হাফিজ ও হাসান বিজয়পুরে পৌঁছিলে তাদের সাথে শিমুলকে না দেখে পলাশ জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া আপু কই ? আপুকে না নিয়ে তোমারা একারা ফিরে এলে যে? সে কোথায়?

হাফিজের কাছে শিমুলের কাহিনী শুনে পলাশ হাউমাউ করে কেঁদে উঠল । কান্না জড়িত কন্ঠে সে হাফিজকে জিজ্ঞেস করল, এ তুমি কি বলছ ভাইয়া, আপুর জন্য আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আমার আপুকে এনে দাও ভাইয়া, আপুকে এনে দাও । এক পর্যায়ে পলাশ মুর্ছা গেল । সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতরণা হলো । কান্নার শোরগোলে স্বাধীনতার আনন্দ এখানে ম্লান হয়ে গেল ।

হাফিজদের বাড়ি কয়েকদিন মেহমান থেকে একদিন হাসান তাকে বলল ;” আর কত দিন তোদের এখানে থাকব ? এবার তো আমায় ঘরে ফিরতে হয় । মাকে কথা দিয়ে এসেছি দিন কয়েক থেকে ফিরে যাব তার কাছে ।”

ঠিক আছে যাবি কিন্তু;তুই একা ফিরে যাবি ? শিমুল দেশের জন্য শহীদ হলেও পলাশ তো রয়েছে । পলাশকে আমি তোর হাতে তুলে দিতে চাই । তুই তাকে সাথী করে সঙ্গে নিয়ে যা । পলাশ তোর পাশে পাশে থাকলে শিমুলের আত্মাটা হয়তো এতটুকু শান্তি পাবে । তেমনি শিমুলকে হারানোর ব্যথা কিছুটা হলেও ভুলতে পারবি ।

আর আমরাও দু’টি মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বিনি সুতোয় বাঁধা রয়ে যাব চিরদিন।

লেখক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত