নানা সংকটে মুখ থুবড়ে পড়েছে মোংলার দিগরাজ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন

মাসুদ রানা,মোংলা

আপডেট : ০৩:৫৩ পিএম, বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০১৯ | ৬৩৫

পুঞ্জিভুত নানা সংকটে মুখ থুবড়ে পড়েছে মোংলার দিগরাজে অবস্থিত মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দূর্নীতি অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি বছরের পর বছর ধরে বিকলঙ্গ হয়ে পড়ে আছে। এ প্রতিষ্ঠানের বরফ কল, ফিস মিল ও ফিস নেট ফ্যাক্টরি শেষ কবে নাগাদ চালু হয়েছিল তাও কেউ জানেন না। বছরের পর বছর ধরে অকেজ হয়ে পড়ে থাকা কয়েক কোটি টাকার যন্ত্রাংশ মরিচা পড়ে নস্ট সহ লাখ লাখ টাকা মূল্যের মেশিনারিজ লোপাট হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীন তিনটি পুকুরের পানি বিক্রি, ফলজ, কৃষি বহিরাগতদের জমি লিজ ও ঘর ভাড়া দিয়ে এখন কাগজে-কলমে আর নামেই শুধূ টিকে আছে প্রতিষ্ঠানটি।


সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ১৯৭৪ সালে মোংলার দিগরাজ এলাকায় বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন নামের ওই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে। স্থাপিত হওয়ার পর এটি বেশ খ্যাতি অর্জন করে। তখন এ প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা ও কর্মচারী সহ চুক্তি ভিত্তিক জনবলের সংখ্যা ছিল ২৫০ জন। আর এ প্রকল্প থেকে বরফ, ফিস মিল, নেট জাল, কীটনাশক উৎপাদন, ও বিদেশে হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি করে লাভজনক হিসাবে প্রতিষ্ঠানটি খুব অল্প সময়েই পরিচিত নেয়। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি এখন যৌলুস হারিয়ে ফেলেছে। এখন পরিনত হয়েছে ভগ্নদশা প্রতিষ্ঠানে। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের অবস্থা বড়ই করুন। এ প্রতিষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক, উপ-সহকারী প্রকৌশলী, একাউন্ট্যান্টসহ ৩৯ টি পদ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা মাত্র ১৪ জন। আর বাকী পদ সমূহ বছরের পর বছর শূন্য রয়েছে। একমাত্র বরফ কলটি দীর্ঘ ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া মৎস্য অবতরন কেন্দ্র ,ফিস মিল ফ্যাক্টরি ও ফিস নেট ফ্যাক্টরি বছরের পর বছর ধরে একই অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের চাকা সর্ব শেষ কবে নাগাদ ঘুরেছে তা জানেন না অধিকাংশ কর্মচারীরা। ৭০ দশকে এ প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্ধ ৬টি নৌযান এখনও কাগজে কলমে রয়েছে। এ সব নৌযান কেউ চোখে দেখেছে এমন লোক খুঁজে পাওয়াই মুসকিল।

কর্তৃপক্ষ জানান, কয়েক দশক আগেই ওই নৌযান সমূহের অত্বিত্ব শেষ হয়ে গেছে। কর্পোরেশনের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বসবাসের জন্য ২০ কক্ষ বিশিষ্ট ৫ তলা ভবন একটি, আধাপাকা ১৫-১৬ কক্ষ বিশিষ্ট ৭ টি ভবন রয়েছে। লোকবল কম থাকায় আবাসিক ভবন গুলো ব্যবহৃত না হওয়ায় জরাজীর্ন কুটিরে পরিনত হয়েছে। পরিত্যাক্ত বেশ কয়েকটি ভবনে এখন পোকা-মাকড় ও বিষাক্ত সাপের বসবাস। অধিকাংশ ফ্যাক্টরি যন্ত্রাংশ মরিচা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি ভবনের জানালা -দরজাও নেই, খসে পড়ছে প্লাষ্টার ও ভবনের ইট। ইতিমধ্যে বন্ধ কল কারখানার লাখ লাখ টাকার মেশিনারিজ লোপাট হয়ে গেছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে কর্তৃপক্ষের কতিপয় কর্মকর্তা কর্মচারি চাকরি থেকে বহিস্কার সহ হাজতবাসও খেটেছেন বলে জানা গেছে।


তবে ১৯৯৬ -৯৭ অর্থ বছরে কর্পোরেশনের ৫ তলা ভবনের ২০টি কক্ষ বিদ্যুৎ-পানিসহ মাসিক ৩ হাজার টাকা এবং আধাপাকা টিন সেডের ১৭টি কক্ষ ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় বহিরাগতদের কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছে। বহিরাগতদের আনাগোনা এবং মাদক ও জুয়া সহ এখানে চলছে নানা অনৈতিক কর্মকান্ড। আর এ নৈতিক কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করায় বর্তমান প্রকল্পের এক কর্তার ইন্দনে বহিরাগতদের হাতে প্রতিষ্ঠানের নৈশ্য প্রহরী ও মসজিদের ইমামও শারিরীক নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কারনে এখানের অভ্যন্তরীন বিষয় নিয়ে মুখ খোলার সাহষ পান না অন্য কর্মচারীরা।


এ প্রতিষ্ঠানটি পুকুর থেকে পানি বিক্রি, ঘর ভাড়া ও নারকেল-সুপারি ফলফলাদী এবং জমি ইজারার আয়ের উপর নির্ভর করে চলছে। এ ছাড়া প্রকল্পের ৩টি পুকুরের পানি ওয়াটার প্লান্টের মাধ্যমে বানিজ্যিকভাবে বিক্রি করা হয়ে থাকে। প্রতিমাসে গড়ে ১ লাখ টাকা ঘর ভাড়া আর ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার পানি বিক্রি, ফলজ গাছের ইজারায় ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা আয় হয়। এ ছাড়া ৩টি পুকুরে শৌখিন মাছ শিকারীদের বড়শি দিয়ে মাছ ধরার জনপ্রতি ১২শ’ টাকা দরে টোকেন দেয়া হয়। প্রতিদিন অসংখ্য মাছ শিকারীর ভীড় থাকে প্রকল্পের ৩টি পুকুরে। প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে আয়ের এ নগদ অর্থ কর্মকর্তার পকেটস্থ সহ হরিলুট হয়ে থাকে বলেও অভিযোগ রয়েছে। গত ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে গড় আয় ৩৩ লাখ টাকা আর ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৪৬ লাখ টাকা। প্রকল্পের অভ্যন্তরে তেমন কোন কাজ না থাকায় কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অনেকটা গা ভাসিয়ে সময় পার করছেন। প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীন অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনাসহ অসামজিক কর্মকান্ডের নানা বিষয় উল্লেখ করে ইতিমধ্যে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে গনস্বাক্ষরিত লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন প্রকল্প সংলগ্ন দিগরাজ এলাকার বাসিন্দারা।


স্থানীয়রা জানান, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারনে সরকারি এই প্রাতষ্ঠানটি ধীরে ধীরে যৌলুস হারাতে থাকে। এখন এটি একটি রুগ্ন শিল্প হিসাবে কর্তৃক্ষের কাছে বোঝা হয়ে দাড়িয়েছে। কর্তৃপক্ষ একটু দৃষ্টি দিলেই মোংলা মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন নামের এ প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক খাতে পরিনতসহ বছরে ৫ কোটি টাকার বেশি আয় করা সম্ভব। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সম্ভাবনাময় এ প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয় বলে জানালেন স্থানীয়রা। তবে কর্পোরেশনের ম্যানেজার নাইম অহমেদ রিয়াদ বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, ২০১৯ সালের ৬ জানুয়ারী তিনি এখানে বদলী হয়ে আসেন। ফলে অনেক অব্যবস্থাপনা দূর হয়েছে। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানটি লাভে রয়েছে দাবি করে তিনি জানান, পুকুরের পানি বিক্রি, ঘর ভাড়া আর ফলজ বাগানের ইজারা দিয়ে এখন আগের তুলনায় বেশ ভাল আয় হচ্ছে। গড়ে বছরে প্রায় ১ কোটি টাকা আয় হলেও কর্পোরেশনের ভবন, রাস্তা সংস্কার ও পুকুরে মাছ অবমুক্ত, কর্মচারীদের বেতন সহ সকল খরচ মিটিয়ে গত অর্থ বছরে ৪৬ লাখ টাকা মুনফা রয়েছে। অনিয়ম অব্যবস্থপনার বিষয় তিনি বলেন, এ সব আগে হয়েছে, তিনি আসার পর সংশোধনীসহ নজরদাড়ি বাড়িয়েছেন। প্রকল্পের অভ্যন্তরে নিয়ম ভঙ্গ করে থাকা বহিরাগতদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা করছেন। তার ভাষায় এ প্রকল্প নিয়ে আরও সুখবর রয়েছে, মোংলা সমুদ্র বন্দর কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে। তাই এ প্রকল্পের উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। আর এ পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি শিপ ইয়ার্ড করার জন্য গত দু’মাস আগে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে ৭৩ কোটি টাকার একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত