মোংলায় নৌ-পুলিশের ওসি’র বিরুদ্ধে টোকেন বাণিজ্যের অভিযোগ

মোংলা প্রতিনিধি

আপডেট : ০৬:২৫ পিএম, বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০১৯ | ৬১৫

সুন্দরবন সংলগ্ন মোংলার চাঁদপাই নৌ-থানা পুলিশের ওসি’র বিরুদ্ধে জব্দকৃত মালামাল ও নগদ টাকা আত্মসাৎসহ ‘টোকেন’ বাণিজ্য ও ঘুষ দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠেছে। ওসি আবুল হোসেন শরিফের একের পর এক অনিয়ম ও অপতৎপরতায় ফুঁসে উঠছে সুন্দরবন সংলগ্ন জয়মনি গ্রামের পেশাজীবী সহ সাধারণ মানুষ। নিরীহ মানুষকে ক্রসফায়ার ও ডাকতি সহ মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ও অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। নৌ পুলিশের ওসি’র অনৈতিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে জয়মনি এলাকার গ্রামবাসিরা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছে। ভুক্তভোগীরা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও গনমাধ্যমকর্মীদের কাছে নৌ পুলিশের অর্থ বাণিজ্য এবং অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে এবং এর প্রতিকার চেয়ে মানববন্ধন করেছে এলাকাবাসী।

সুন্দরবন ও নৌ পথের চোরাচালান রোধে মংলার জয়মনিতে ২০১৭ স্থাপিত হয় চাঁদপাই নৌ-থানা। এ থানার শুরুতেই নিরাপত্তা, চোরাচালন বন্ধসহ অপরাধী চক্রের আনাগোনা কমবে বলে আশায় বুক বেঁধেছিল এলাকার জেলে-বাওয়ালি ও সাধারণ মানুষ। কিন্তু নৌ-থানা পুলিশের কার্যক্রম দু’মাস যেতে না যেতেই পেশাজীবী ও সাধারণ নিরীহ মানুষকে ঘিরে ওসি আবুল হোসেন নেমে পড়েন নানা অনিয়ম ও অর্থ বাণিজ্য। এখানে যোগদানের পর দুই বছরের অধিক সময় ধরে একই থানায় থাকা এ পুলিশ কর্মকর্তার জড়িয়ে পড়েছেন নানা অনিয়মে।

জয়মনি গ্রামের গৃহবধু রহিমা বেগম জানান, সন্ধ্যার পর যুবক থেকে বয়স্ক ও পেশাজীবীরা নামলেই নৌ পুলিশের আতংকে থাকতে হয়। যখন তখনও যে কাউকে মিথ্যা অভিযোগ তুলে মোটা অংকের টাকা দাবি করেন নৌ পুলিশের সদস্যরা। তাই এমন হয়রানী থেকে রেহাই পেতে মাথাপিছু ২শ’ টাকা করে তাদের দিতে হয় নৌ পুলিশকে । আর এ মাসিক টাকা না দিলে নানা বিপদে পড়তে হয় নিরীহ মানুষকে। এ ছাড়া সুন্দরবনের অভ্যন্তর ও পশুর নদীতে জেলে,বাওয়ালী-মৌয়াল সহ পেশাজীবীদের বহন করতে হয় ওসি আবুল হোসেনের ‘বিশেষ টোকেন’ কার্ড। প্রতি মাসে জন প্রতি ৫শ’টাকা করে দিতে হয় এ টোকেন কার্ডের জন্য। বনবিভাগের বৈধ পাস পারমিট থাকলেও নৌ পুলিশের টোকেন কার্ড ছাড়া কেউ নদীতে নামতে পারেন না। কেউ না বুঝে আবার কেউ না বুঝে নৌ পুলিশের এ টোকেন ছাড়া নদীতে নামলে তাকে ডাকাত কিংবা অপরাধী সাজানোর চেষ্টা সহ উৎকোচ আদায়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়। এ ছাড়া জয়মনী রুট দিয়ে বিদেশী জাহাজে যাতায়াতকারী বিভিন্ন ফেরী ওয়ালাসহ চোরাচারবারীরা ওসিকে মাসিক ভিত্তিক নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হয়।

জয়মনি গ্রমের জহুরুল গাজী ও সুলতান হাওলাদার বলেন, নৌ থানার ওসি’র এ বিশেষ টোকেন নিয়ে চলতে হয় সবাইকে। সুন্দরবনে ও পশুর নদীতে জেলে-বাওয়ালীসহ প্রায় ৩ শতাধিক পেশাজীবীর কাছে রয়েছে এমন টোকেন। অপর দিকে বেশি লাভের আশায় এ টোকেন নিয়ে নিষিদ্ধ মৌসুমে সুন্দরবনের নদী খালে মাছ ও কাঁকড়া আহরন করে থাকেন ওসি আবুল হোসেন শরিফ এর অনুগতরা। নদীতে অভিযানে ও টহলদান কালে টোকেন বিহীন জেলেদের জাল-নৌকা মাছ ধরার সরঞ্জামাদী থানায় এনে পরে অন্যত্র বিক্রি করার অভিযোগও রয়েছে ওসি’র বিরুদ্ধে। এ ছাড়া বনের নদী-খালে বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার,হরিণ শিকার সহ অপরাধী চক্রের সঙ্গে বেশ সখ্যতাও রয়েছে তার। চিংড়ি পোনা মৌসুমে বাগদা ও গলদা রেনু আহরন মৌসুমে পোনা অহরনকারীদের সহায়তার মাধ্যমে নৌ পুলিশের সব চেয়ে বেশি আয় হয়ে থাকে বলে জানান স্থানীয়রা। শুধু নৌ পথ নয়, লোকলয় ও রয়েছে নৌ পুলিশের ব্যাপক অপতৎপরতা। স্থানীয় হাট-বাজারের মাছের আড়ৎ জেলে মহাজনসহ ক্রেতা ও বিক্রেতাদের কাছ থেকেও নিয়মিত ও মাসিক উৎকোচ আদায় করে থাকে চাঁদপাই নৌ পুলিশকে।

এছাড়া সড়কে চলাচলকারী মটরসাইকেল,টমটম সহ বিভিন্ন যানবাহন ও ক্যারাম বোর্ড হতেও চাঁদা দিতে হয়। কাঁকড়া চাষাবাদ মৌসুমে স্থানীয় প্রায় ২শ’২০টি হ্যাচারি মালিকদের কাছ থেকে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা করে আদায় করেন তার দুই সঙ্গিসহ সরাসরি ওসি নিজেই। আর টাকা না দিলে সুনদরবন থেকে এ কাঁকড়া অবৈধভাবে আহরতি হয়েছে বলেও অভিযোগ তুলে হয়রানী করা হয়। এ দিকে গ্রামের সাধারণ মানুষকে মাদক দ্রব্য সেবন ও বেচাকেনাসহ নানা মিথ্যা অভিযোগ তুলে চাঁদা ও উৎকোচ দাবি করে। তার অনৈতিক চাহিদা পূরনে ব্যর্থ হলে ক্রোসফায়ারসহ মামলায় জড়ানোর ভয় দেখানো হয় বলে অভিযোগ করেন এলাকাবাসি। অবৈধ পথের এ সকল আয় বানিজ্যি দেখভাল ও ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করেন আনোয়ারুল হোসেন ও অনুজ নামের ওই থানার দু’পুলিশ সদস্য।

সোমবার রাত ১টার দিকে জয়মনি গ্রামের ৯ যুবককে জুয়া খেলার অভিযোগে আটক করেন নৌ থানা পুলিশের সদস্যরা। আটককৃতদের কাছ থেকে এক লক্ষ ৭০/৮০ হাজার নগদ টাকা জব্দ করা হলেও জব্দ তালিকায় দেখানো হয় ১শ’৭০ টাকা। বৃহস্পতিবার জয়মনি বাজারে সমবেত শত শত গ্রামবাসী নৌ পুলিশের হয়রানী ও অত্যচারের বিষয়টি স্থানীয় চিলা ইউপি চেয়ারম্যানকে অবগত করেন এবং এর প্রতিকার চেয়ে বৃহস্পতিবার সকালে বৈদ্যমারী বাজারে মাবনবন্ধন করে তারা।

স্থানীয় চিলা ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আকবর গাজী অভিযোগ করে বলেন-নৌ থানার ওসি আবুল হোসেন শরিফ টাকা ছাড়া কিছুই চেনেন না। টাকা হলেও তিনি সকল কিছু করতে পারেন। নৌ পুলিশের হয়রানীমূলক কর্মকান্ডে গ্রামের পেশাজী সহ নিরীহ মানুষ এখন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন।

মোংলা চাঁদপাই নৌ থানার ওসি’আবুল হোসেন শরিফ তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ভাল কাজ করতে চাইছেন বলেই তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ছড়াচ্ছে একটি মহল। সকল সময় তিনি ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।

এ ব্যাপারে খুলনা নৌ অঞ্চলের পুলিশ সুপার মোঃ দ্বীন মোহাম্মাদ বলেন, খুলনা সবর্ত্র নৌ পুলিশ সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। তাই অনিয়মে জড়ানোর সুযোগ নেই। তবে লিখিত অভিযোগ পেলে চাঁদপাই নৌ-পুলিশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত