সুন্দরবনের প্রাণ প্রকৃতি নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবেশবিদ ও সাধারন মানুষ

পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়াই সুন্দরবনের অ-দুরে নির্মিত হচ্ছে বেসরকারী বিদ্যুৎ কেন্দ্র

স্টাফ রিপোর্টার

আপডেট : ১০:১৯ পিএম, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০১৯ | ১৬১১

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান নিয়ে সুন্দরবন রক্ষায় জাতিসংঘের ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ ফাইন্ডেশনসহ দেশী-বিদেশী পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর উৎকণ্ঠার মধ্যে এবার সুন্দরবনের কোল ঘেষে বাগেরহাটের মোংলায় বেসরকারী উদ্যোগে নির্মাণ করা হচ্ছে ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক নতুন একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই উৎকন্ঠার মধ্যে আবার সুন্দরবনের প্রতিবেশ সংকটাপন্ন ১০ কিলোমিটার ইসিএ ভূক্ত এলাকার মাত্র ৫ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৭ একর জমির উপর পাওয়ারপ্যাক নামে ১০০ মেগাওয়ার্ট এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির অবকাঠামো নির্মাণ কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের উপমন্ত্রী বলেছেন, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানে কোন পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়া হয়নি। এদিকে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর বলছে, বিদুৎ কেন্দ্রটি নির্মান হলে আবারো সুন্দরবনের ‘শেলা ট্রাজিডি”র সৃষ্টি হবে। অস্বিত্ব সংকটে পড়বে বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবন। তারা দাবী জানিয়েছেন বিদুৎ কেন্দ্রটি সুন্দরবনের ইসিএভূক্ত এলাকা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার।

‘দেশের অক্সিজেনের ভান্ডার’ ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের প্রান-প্রকৃতির জীবন্ত হুমকি হচ্ছে ফানের্স অয়েল। দেশের সর্বমোট বনাঞ্চলের ৫১ ভাগই হচ্ছে সুন্দরবন। ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর মোংলার অদুরে সুন্দরবনের শেলা নদীতে ৩ লাখ টন ফার্নেস অয়েল নিয়ে ডুবে যায় ‘সাইার্ন স্টার- ৭ নামের একটি অয়েল ট্যাঙ্কার। দিনে দু,বার জোয়ারের পানিতে প্লাবিত বিশ্বের বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের কয়েক লাখ হেক্টর বনভূমির গাছের শ্বাসমূলসহ নদী-খালে ছড়িয়ে পড়ে ফার্নেস অয়েল। অস্তিত্ব সংকটে পড়ে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদরাজি, ‘বিলুপ্ত প্রাজাতির ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রানী ও ২৯২ প্রজাতির মৎস্য সম্পদ। তখন সুন্দরবনকে বাঁচাতে খোদ জাতিসংঘের ২৫ সদস্যের বিশেষজ্ঞ দলকে ছুটে আসতে হয় সুন্দরবনে। সুন্দরবনে ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কয়েক বছর সময় লেগেছে। এখন ম্যানগ্রেভ এই বনের পশুর চ্যানেল দিয়ে অয়েল ট্যাঙ্কারে করে ফার্নেস অয়েল এনে সুন্দরবন সন্নিহিত মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলে চালানো হবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সুন্দরবনের ইসিএ ভূক্ত এলাকার মাত্র ৫ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক ১০০ মেগাওয়ার্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের খবরে শুধু পরিবেশবাদিরাই নয়, সাধারন মানুষের মধ্যেও সুন্দরবনের প্রানপ্রকৃতি নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।

সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন গবেষক ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, সুন্দরবনের জীববেচিত্র্যের জন্য হুমকি হচ্ছে ফানের্স অয়েল। আমরা সুন্দরবনে আর একটি শেলা ট্রাজিডি দেখতে চাইনা। ১৯৯৭ সালের জাতীয় পরিবেশ কমিটির ৪র্থ সভার (৩,৪,৫) সিদ্ধান্ত ও আমার দায়ের করা হাইকোটের রিট মামলায় (১২৪৬৭/২০১৭) সুন্দরবনের ইসিএভূক্ত এলাকাতে বিপজ্জনক শ্রেনীভুক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এরপরও সুন্দরবনের ইসিএভূক্ত এলাকার মাত্র ৫ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের অনুমোদন দেয়া থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। আমরা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের বিরোধী নই। সুন্দরবনকে আর অস্তিত্ব সংকটে ফেলতে দেয়া যাবেনা। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সুন্দরবনের ইসিএভূক্ত এলাকা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে।

মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলে নির্মানাধীন পাওয়ারপ্যাক ১০০ মেগাওয়ার্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, নামের এই বেসরকারী কোম্পানীটি ২০১২ সালে বিদ্যুৎ মন্ত্রনালয় থেকে এই বিদুৎ প্রকল্পটির অনুমোদন পায়। আর ২০১৭ সালে মোংলা বন্দর সংলগ্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে এটি স্থাপনের জন্য আবেদন করে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) রির্পোট ও পরিবেশগত ছাড়পত্র পেয়েছেন দাবী করে আরও বলেন, প্রকল্প এলাকার মাটি পরীক্ষা হয়ে গেছে। ডিজাইনের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এখন পাইলিংয়ের কাজ চলছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সুন্দরবনের কোন ক্ষতি করবেনা বলেও জানান তিনি।

তবে, বাস্তব অবস্থা হচ্ছে ইতিমধ্যেই অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। নির্মানাধীন পাওয়ারপ্যাক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকায় বহিরাগতদের প্রবেশ করতে না দিয়েই এই কোম্পানীটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ একাধিক লাল বিপজ্জনক শ্রেনীভুক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাইবোর্ড দিয়ে পুরোদমে চলছে বালু ভরাটসহ সড়ক, পাইলিং ও অবেকাঠামো নির্মান কাজ।

এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের বিষয়ে সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের জন্য কোন পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়া হয়নি। বাগেরহাটের রামপাল-মোংলা আমার নির্বাচনী এলাকা। সুন্দরবনের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন ১০ কিলোমিটার ইসিএ ভূক্ত এলাকাতে বিপজ্জনক শ্রেনীভুক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমোতি দেয়া হবেনা। সুন্দরবন শুধু আমাদের জাতীয় সম্পদই নয়,- ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ এই ম্যানগ্রেভ বন ‘দেশের অক্সিজেনের ভান্ডার। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যকে রক্ষায় সরকার সচেতন রয়েছে। তাই মোংলায় পরিবেশ দূষন করার মত কোন প্রতিষ্ঠান কখনোই পরিবেশ ছাড় পত্র পাবেনা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত