খুলনার গল্লামারীতে মুক্তিযুদ্ধ কালীন শহীদের জন্মভূমি চিতলমারীতে

শহীদ মানিক মিয়ার নামে ৪৬ বছরেও হয়নি স্মৃতিফলক

মোঃ একরামুল হক মুন্সী

আপডেট : ০৪:৫৫ পিএম, বৃহস্পতিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০১৭ | ১৮৯৯

খুলনার গল্লামারীতে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জয়নুল আবেদীন মানিক মিয়ার জন্মভূমি চিতলমারী উপজেলায়। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও তাঁর নামে এখানে হয়নি কোন স্মৃতিফলক। ফলে তাঁর জন্মভূমি চিতলমারীর বর্তমান প্রজন্মের প্রায় ৯৯ ভাগ মানুষ জানেনা- শহীদ জয়নুল আবেদীন মানিক মিয়া কে ছিলেন, কী ছিল গর্বিত সেই ইতিহাসে? তাদের জানানোর জন্য প্রবীন মুক্তিযোদ্ধা কিংবা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন বর্তমান প্রজন্মের অনেকে!

খুলনার নিরালা সিটি কলেজ ছাত্রাবাস চত্ত্বরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জয়নুল আবেদীন মানিক মিয়ার মাজার এবং খুলনার সোনাডাঙ্গায় রয়েছে শহীদ সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন মানিক মিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর যুদ্ধস্থল গল্লামারী স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার শীর্ষে রয়েছে তাঁর নাম।

মুক্তিযুদ্ধের তালিকায় নতুন নাম অন্তর্ভূক্তিতে যতটা গুরুত্ব দিতে দেখা যায়, তার কিঞ্চিৎ পরিমাণ উদ্যোগও নিতে দেখা যায়নি এই অকুতোভয় চিতলমারীর সন্তানের মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের নিকট তুলে ধরার ক্ষেত্রে। অথচ তাঁর নামে ২০১৪ সালে চিতলমারীতে গঠিত হয় ‘‘শহীদ সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন মানিক মিয়া ও হাজেরা মানিক স্মৃতি সংসদ’ । যার ৯ সদস্যের উপদেষ্টা মন্ডলীর প্রধান উপদেষ্টা বাগেরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দীন এবং ২৭ সদস্য বিশিষ্ট কার্যকরী কমিটি রয়েছে। সেখানে পদাধিকারবলে সভাপতি চিতলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সাধারণ সম্পাদক রয়েছেন মানিক মিয়ার ছোট ছেলে শেখ মোঃ শামসুদ্দোহা বাঙ্গালী। প্রাথমিক পর্যায়ে চিতলমারী শহীদ মিনারের সামনে ওয়াপদা রাস্তার পাশে একটি সাইনবোর্ড কিছুদিন দেখা গেছে। কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও সেই শক্তিশালী কমিটির কোন কার্যকারিতা নজরে তো পড়েই না; উপরন্তু নাম সর্বস্ব সাইনবোর্ডটিও বর্তমান নেই।

‘শহীদ সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন মানিক মিয়া ও হাজেরা মানিক স্মৃতি সংসদেরর সাধারণ সম্পাদক শেখ মোঃ শামসুদ্দোহা বাঙ্গালী বর্তমানে খুলনায় অবস্থান করেন। তিনি বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, ‘‘সংসদের উন্নয়নের জন্য প্রচেষ্টা চলছে, অচিরেই স্থাপনা নির্মান কাজ শুরু হবে।’’

প্রবীন মুক্তিযোদ্ধাদের বক্তব্য এবং ‘চিতলমারীর ইতিহাস’ গ্রন্থ হতে জানা যায়, অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন মানিক মিয়া মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক একটি নাম। যে সকল মুক্তিযোদ্ধার রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন দেশের মুখ দেখতে পাচ্ছি তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন শহীদ সুবেদার মেজর জয়নূল আবেদীন মানিক মিয়া। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখনও তার নামে চিতলমারীর প্রাণকেন্দ্রে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করা হয়নি। অথচ উপজেলা সদর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দুরে আড়–য়াবর্নী গ্রামে তাঁর জন্মস্থান। ১৯২৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম শেখ লেহাজ উদ্দিন, মাতা মরহুমা মাজুবিবি। উপমহাদেশে ইংরেজদের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য মানুষ যখন উদ্বিগ্ন ঠিক সে মুহুর্তে বাগেরহাট পিসি কলেজে অধ্যয়নরত তরুন যুবক জয়নূল আবেদীন ভারত বর্ষের সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। জয়নুল কর্মকালীন বহু সম্মাননা ও উপধিতে ভূষিত হয়েছেন।

একাত্তরের ২৬ মার্চ রেডিও যোগে স্বাধীনতার খবর পেয়ে অবসর সেনা কর্মকর্তা জয়নুল আবেদীন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। ঘরে ছিল দ্বোনলা বিশিষ্ট একটি আগ্নেয়াস্ত্র (বন্দুক) এবং কিছু কার্তুজ। তা নিয়ে তিনি অগ্রসর হন যুদ্ধাভিমুখে। জয়নূলকে বাঁধা প্রদান করেন তার স্ত্রী হাজেরা মানিক। কিন্তু তিনি সুকৌশলে তাকে এড়িয়ে যান। এরপর হাজেরা তাঁর স্বামীকে রোধ করতে স্থানীয় মুরব্বিদের নিকট গিয়েও বিফল হন।

অতঃপর জয়নুল চিতলমারী উপকন্ঠে সমবেত জনতার উপস্থিতিতে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠিকে বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত করবার জন্য এক জ্বালাময়ী ভাষন দেন। এ সময় তার ভাষনে স্বদেশ প্রেমে উদ্ধুদ্ব হয়ে তৎকালীন কিছু ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য সেচ্ছায় জয়নুলের সাথে অগ্রসর হন বাগেরহাট অভিমূখে। তার সহযোগীদেও নিয়ে অগ্রসর হন খুলনা অভিমূখে। মূললক্ষ্য ছিল খুলনার গল্লামারী রেডিও সেন্টার এলাকায় মুক্তিযোদ্ধার ঘাঁটি স্থাপন করা, পাকসেনাদের অবস্থান দেখা ও যুদ্ধের নকশা তৈরি করা। এ সময় গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে জয়নুল বেশ ক’বার পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে কৌশলে মুক্তিও পান।

খুলনার গল্লামারী পাকিস্তানিদের যুদ্ধের একদিন আগে বানিয়াখামার এসে শেখ আবদুর রাজ্জাক, কামরুজ্জামান টুকু, সম বাবর আলী, শেখ কাইয়ুম, অছিকুর রহমান সহ বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে পরামর্শ করেন তিনি। জয়নুল যেদিন পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন ওইদিন ছিল ৩রা এপ্রিল ১৯৭১ রাত ১২টা। উদ্দেশ্য ছিল পাকসেনাদের গল্লামারি রেডিও সেন্টারে যাওয়ার গতিপথ রুদ্ব করা।

সাথী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নির্মিয়মাণ সিটি কলেজ হোস্টেলের চিলেকোঠায় অবস্থান নেন। পরদিন সকালে পাকসেনাদের গাড়ি আসতে শুরু করে। জয়নুল ওই গাড়ি বহরে গোলাবর্ষণ করতে থাকেন। একেএকে ধ্বংস হয় পাকসেনাদের একটি জিপ ও দুটি মিলিটারি ট্রাক। তুমুল যুদ্ধে এলোপাথাড়ি গোলাবর্ষণে জয়নুলের সাথী মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হঠে যায়। এ সময় জয়নুলের বুলেটের আঘাতে প্রায় ৭৪জন পাকসেনা নিহত হয়। এ সম্মুখ যুদ্ধে এক সময় পাকসেনাদের ব্রাশ ফায়ারে জয়নুলের বুক, মাথা এবং শরীরের বিভিন্ন স্থান ঝাঁঝরা করে দেয়।

নিস্তব্দ হয়ে যান মহান মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি শহীদ সুবেদার মেজর জয়নূল আবেদীন মানিক মিয়া। স্বামী শহীদ হবার খবর শুনে অন্তঃসত্ত্বা হাজেরা মানিক অচেতন হয়ে পড়েন। পুনরায় তার জ্ঞান ফেরেনি, তিনিও মৃত্যুবরণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধের এই মহান আত্মত্যাগী বীরের ইতিহাস চিতলমারীর বর্তমান প্রজন্মকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া জরুরী বলে দাবী করেছেন সচেতন মহল। তাঁরা দাবী করেন অচিরেই যেন স্মৃতিফলক নির্মান করা হয়। জয়নুল আড়–য়াবর্নী গ্রামের যে ঘরটিতে জন্ম গ্রহন করে ছিলেন সে ঘরটি জরাজীর্ন অবস্থায় আজও জয়নুলের স্মৃতি বহন করছে। সেখানে বসবাস করছেন তাঁর ছোট ভাই অবঃ শিক্ষক শেখ নোয়াবালী ।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত