রামপালে জমি আছে ঘর নাই

প্রকল্পের আওতায় নির্মিত ঘরগুলিতে ৩ মাসেই ফাটল

এম,এ সবুর রানা,রামপাল

আপডেট : ০৪:৩৩ পিএম, শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২০ | ৯০৫

রমেশ মন্ডল (৪৫) বাস করেন উপজেলার মল্লিকেরবেড় ইউনিয়নের ছোট সন্যাসী গ্রামে। তার পেটের নাড়িতে প্যাচ লাগায় খুমেক হাসপাতাল থেকে মেজর অপারেশন করা হয়েছে। চিকিৎসকগণ তাকে বাঁচাতে পেটের ভেতর থেকে মলত্যাগ করতে বিকল্পভাবে নল সংযোজন করে দিয়েছে। বর্তমানে তিনি জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দিনযাপন করছেন। তার ছোট্ট এক খন্ড জমি আছে। কিশোর বয়সের একটি মাত্র ছেলে। সংসারের ঘানি টানছেন স্ত্রী শুকলা মন্ডল।

স্বামী সন্তানকে বাঁচাতে মোংলা ইপিজেডে এ শ্রমিকের কাজ নিয়েছেন। জমি আছে ঘর নাই প্রকল্পের আওতায় তাকে দূর্যোগ সহনশীল একটি সেমিপাকা ঘর দেওয়া হয়েছে। ওই ঘর নিতে তাকে পরিবহণ বাবদ গুনতে হয়েছে ৩৫ হাজার ৫ শত টাকা। এছাড়াও মিস্ত্রী ও শ্রমিকদের খাবার বাবদ গুনতে হয়েছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। তিনি আরো জানান, তাকে দেওয়া ঘরে লাগানো হয়েছে নিম্নমানের কাঠ। ইট ও বালি বাবদ গুনতে হয়েছে ১৫ শত টাকা। একইভাবে উপজেলার হুড়কা ইউনিয়নের চাড়াখালী গ্রামের অসুস্থ্য আজাহার আলী শেখকে একটি ঘর করে দেওয়া হয়েছে। ওই ঘরেও তাকে পরিবহন বাবদ গুনতে হয়েছে ৪০ হাজার টাকা।

মাত্র ৩ মাস পরে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় ঘরের পিলারসহ বিভিন্ন স্থানে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। মেঝে ও দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে। ঘরে লাগানো নিম্নমানের কাঠ কোথাও কোথাও বেকে গেছে। আজাহারের স্ত্রী তাসলিমা বেগম বাগেরহাট২৪কে জানান, এই ঘর করতে তার পরিবহন বাবদ খরচ হয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। তিনি দুঃখ করে বলেন, আমাগো সরকারিভাবে যে ঘর দিয়া ওইচে তাতে থাকতি ভয় নাগদিছে। শুনিলাম আমার খরজের টাহা ফেরত পাবানি কিন্তু তা এ্যাহোনো পয্যন্ত পাইনেই।

উপজেলার গৌরম্ভা ইউনিয়নের ছায়রাবাদ গ্রামের আকরাম শেখের স্ত্রী আফরোজা বেগমের বাড়িতে গেলে তিনি বাগেরহাট২৪কে জানান, এই ঘর কত্তি আমার নাগিচে ৪০ হাজার টাহা। কিছু কাঠ ও আমার দিয়া নাগিচে। পাইখানাডা এ্যাহোনো ঠিক করে দিনেই। পার্শবর্তী বর্ণি গ্রামের ফিরোজ শেখের বিধবা স্ত্রী শিরিনা বেগম বাগেরহাট২৪কে জানান, তাকেও পরিবহন খরচ দিতে হয়েছে ২৫ থেকে ২৬ হাজার টাকা। তার ছেলে পিয়ার আলী জানান, এখনও পর্যন্ত ঘরের কিছু কাজ করতে বাকি রয়েছে। এভাবে হুড়কা ইউনিয়নের ছিদামখালী গ্রামের অজয় মন্ডলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় তার ঘরের ও বিভিন্ন জায়গায় ফাটল ধরেছে। ঘরের মালামাল পরিবহন, মিস্ত্রী ও শ্রমিকদের খাওয়া বাবদ খরচ হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। তিনি আরও জানান, ওই সময় শ্রমিকদের চা খাওয়ার জন্য চিনি ক্রয় করা হয়েছে সাড়ে ৩ থেকে ৪ কেজি এবং দেড় কেজী চা পাতি।

জমি আছে ঘর নাই প্রকল্পের আওতায় ২২টি সেমিপাকা ঘর নির্মানে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর বাগেরহাট জেলা প্রশাসক ও রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তুষার কুমার পাল এর আশ্বাসের পরও কোন সুফল মেলেনি। গ্রামীন অবকাঠামো (টিআর) রক্ষনাবেক্ষনের বিশেষ কর্মসূচীর আওতায় উপকূলীয় অঞ্চলের হতদরিদ্রদের মাঝে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও জীবন মান উন্নয়নের লক্ষে এ ঘর বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে গৃহহীনদের অনেকেই এই ঘর পায়নি। যারা পেয়েছে তাদের গুনতে হয়েছে মোটা অংকের টাকা। ঘর নির্মানের অনিয়মের মধ্যে রয়েছে, ঘরের চালে, দরজা, জানালায় ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের নির্মান সামগ্রী।

পরিবহন ব্যয়ও উপকারভোগীদের বহন করতে হয়েছে। মেঝেতে বালির পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে মাটি। উপকারভোগীদের শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ করে তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। উল্টো মিস্ত্রীদের দু-বেলা আহার জোগাতে হয়েছে অসহায় এই পরিবারগুলোকে। অভিযোগ রয়েছে গৃহহীনদের বঞ্চিত করে অনেক স্বচ্ছল পরিবারকেও দেওয়া হয়েছে এই ঘর। নিয়ম অনুযায়ী উপজেলা পিআইসি কমিটি প্রকৃত উপকার ভোগীদের যাচাই বাছাই করে প্রেরণের কথা থাকলেও সেটি অনুসরণ করা হয়নি এমন অভিযোগ উঠেছে। জেলা প্রশাসনের মনিটরিং দূর্বল থাকায় ও উপজেলা প্রশাসনের পিআইসি কমিটির উদাসীনতায় ঘর নির্মানে এমন অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে বলে সচেতন মহল মনে করেন।

উপজেলার ২২ টি ঘরের অনকূলে ২ লক্ষ ৫৮ হাজার ৫৩১ টাকা করে মোট ৫৬ লক্ষ ৮৭ হাজার ৬৮২ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে রামপাল উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ নাহিদুজ্জামানের মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বাগেরহাট২৪কে জানান, মাত্র ৩ মাসে ঘরে ফাটল ধরার কথা না। আমাকে কিছু ছবি দেন আমি দেখি। বাচাই বাছাই করে অনিয়মের বিষয় ব্যবস্থা গ্রহন করবো।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তুষার কুমার পাল বাগেরহাট২৪কে জানান, যে সমস্থ ঘরে ফাটল ধরেছে, তারা আমার নিকট অভিযোগ করলে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং কেউ পরিবহন খরচ হিসাবে টাকা নিয়ে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মোঃ মামুন উর রশিদ মুঠোফোনে বাগেরহাট২৪কে জানান, অনিয়মের বিষয়গুলি আমার জানা নাই । নির্দিষ্ট তথ্য পেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত