কাজ না করেও জমা দিয়েছে প্রত্যায়ন ॥ ভূয়া বিল-ভাউচরের ছড়াছড়ি

চিতলমারীতে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির কাজে হরিলুট !

স্টাফ রিপোর্টার

আপডেট : ০৬:১১ পিএম, বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১৯৫০

চিতলমারীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির ক্ষুদ্র মেরামতের জন্য দেওয়া বরাদ্দ, প্রাক-প্রাথমিক, রুটিন মেইন্টেন্যান্স ও স্লিপের টাকা হরিলুটের অভিযোগ উঠেছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক ভূয়া বিলÑভাউচারে মাধ্যমে নাম সর্বস্ব কাজ করে টাকা ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছেন। আর এ অনিয়মের সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন। তাই কাজ না করেও অনেক স্কুল কর্তৃপক্ষ উপজেলা প্রকৌশলী দপ্তরের প্রত্যায়নপত্র জমা দিয়েছেন। আর করোনার ক্রান্তিকালে স্কুল বন্ধ থাকায় তাদের এ কাজের পথ সুগম হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন বিদ্যালয়ের অভিভাবকেরা। তারা সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এ অনিয়ম উদঘাটন ও সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় গুলোর উন্নয়নের জোর দাবি জানিয়েছেন।

উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলায় মোট ১১১ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ক্ষুদ্র মেরামতের জন্য ৪০টি স্কুলে পিইডিপি-৪ তহবিল থেকে ৮০ লাখ ও রাজস্ব তহবিল থেকে ৪ লাখ ৫০ হাজার মোট ৮৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এছাড়া রুটিন মেইন্টেন্যান্সে ৭০টি স্কুলে ৪০ হাজার করে মোট ২৮ লাখ টাকা, স্লীপে ১১১টি স্কুলে ৫০ হাজার করে মোট ৫৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও প্রাক-প্রাথমিকে ১১১টি স্কুলে ১০ হাজার করে মোট ১১ লাখ ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ৪টি প্রকল্পে মোট বরাদ্দের পরিমান ১ কোটি ৭৯ লাখ ১০ হাজার টাকা। যা স্কুলের প্রধান শিক্ষক, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা কাজ না করে ও ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে নাম সর্বস্ব কাজ করে টাকা ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছে বলে বিভিন্ন স্কুলের অভিভাবকরা জানিয়েছেন। তারা সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এ অনিয়ম উদঘাটন ও সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় গুলোর উন্নয়নের জোর দাবিও জানান।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে কয়েকজন সহকারি শিক্ষক বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, বরাদ্দ যত বেশী হবে প্রধান শিক্ষক-সভাপতির লুটপাটও তত বেশী হবে। এ যেন উন্নয়নের নামে হরিলুট। তারাও এগুলো খুঁজে বের করে দোষিদের শাস্তির দাবি জানান।

সরেজমিনে কাননচক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গঙ্গাচন্না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাড়িয়ার ঘোপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বড়গুনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দলুয়াগুনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঘোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বড়বাড়িয়া বাদামতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরলাটিমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুড়ালতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ শিবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কালশিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কাঠিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্কুল ঘুরে জানা গেছে, এসব স্কুলে নাম সর্বস্ব কাজ হয়েছে।


এলাকাবাসিরা অভিযোগ করে বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, চিংগড়ি চরচিংগড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও গোড়ানালুয়া নতুনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোন কাজ হয়নি। তারপরও কাজ না করে স্কুল কর্তৃপক্ষ উপজেলা প্রকৌশলী দপ্তরের প্রত্যায়নপত্র জমা দিয়েছে। তুলে নিয়েছে সমুদয় টাকা।

কুড়ালতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশের বাসিন্দা হরিদাস মন্ডল, দিলিপ বৈরাগী ও কালাচাঁদ বিশ্বাস বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, এই স্কুলে একদিন কোন মতে একটু কাজ হয়েছে। ছাঁদের রেলিং গুলো ভেঙ্গে পড়ছে। ওরা স্কুলের গাছ গুলো বিনা টেন্ডারে বিক্রি করে অর্থ আত্মসাৎ করেছে।

এ ব্যাপারে কাননচক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তপন কুমার গুহ, গঙ্গাচন্না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ জাহিদুল ইসলাম, বড়বাড়িয়া বাদামতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্বপন কুমার মন্ডল, চরলাটিমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সন্তোষ কুমার বিশ্বাস, কুড়ালতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেবা রানী বোস, দক্ষিণ শিবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধানি শিক্ষক মোঃ ইব্রাহীম ফকির ও কাঠিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোঃ আসাদুজ্জামান অভিন্ন সুরে জানান, ক্ষুদ্র মেরামত, স্লীপের ও প্রাক-প্রাথমিকের বরাদ্দকৃত টাকা যথাযথ ভাবে উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা হয়েছে। যার বিল-ভাউচার ও উপজেলা প্রকৌশলী দপ্তরের প্রত্যায়নপত্র শিক্ষা অফিসে জমা দিয়ে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চিংগড়ি চরচিংগড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিজয় কৃষ্ণ পোদ্দার মুঠোফোনে বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, অমুক মেম্বারকে চেনেন। তার ভাই আমার স্কুলের সভাপতি। কোন প্রশ্ন থাকলে তাকে ফোন দেন।

গোড়ানালুয়া নতুনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ এমরানুজ্জামান শেখ বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, আমার স্কুলে নতুন ভবন হচ্ছে। তাই বর্তমান ভবনে কাজ করতে পারছিনা। টাকা আছে, কাজ পরে করা হবে। বাথরুমে কিছু কাজ করেছি।

রহমতপুর দায়িত্বরত ক্লাষ্টার ও সহকারি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ আরিফুল ইসলাম, শান্তিখালির ক্লাষ্টার ও সহকারি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ মামুন হোসেন, বড়বাড়িয়া ও গরীবপুর ক্লাষ্টার ও সহকারি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা তপন কুমার দেবনাথ এবং সুরশাইলের ক্লাষ্টার ও সহকারি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এসএম আলী আকবর অভিন্নসুরে বলেন, সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকদের ভায্যমতে শতভাগ সন্তোষজনক কাজ হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোন অভিযোগ আসেনি।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ আমিনুল ইসলাম বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ উপজেলা প্রকৌশলী দপ্তরের প্রত্যায়নপত্র ও বিল-ভাউচার জমা দিয়েছে। সেই মোতাবেক আমরা অর্থ ছাড় দিয়েছি।

উপজেলা উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাশিদুজ্জামান খান বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, স্কীম অনুযায়ী কাজ হয়েছে। কাজের প্রত্যায়ন পত্রও দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে গোড়ানালুয়া নতুনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাজ হয়নি। সামনে হবে। আর চিংগড়ি চরচিংগড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনে কোন কাজ করা হয়নি। ওই টাকা দিয়ে স্কুল বাউন্ডারীর ওয়ালে রং করা হয়েছে।

তবে চিতলমারী উপজেলা প্রকৌশলী মোঃ জাকারিয়া ইসলাম বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, উপজেলা উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাশিদুজ্জামান খান প্রত্যায়নপত্র গুলো এনে দিলে সেগুলো স্বাক্ষর করেছি। সব কাজ দেখে স্বাক্ষার করা সম্ভব নয়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত