নামে ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ভেতরে রুগ্ন-অস্বাস্থ্যকর!

মহিদুল ইসলাম, শরণখোলা 

আপডেট : ১০:৪৩ পিএম, শুক্রবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ৪৯৯

শুধু নামেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ভেতরের সবকিছুই রুগ্ন-অস্বাস্থ্যকর। চিকিৎসক, জনবল, শয্যা সংকট দীর্ঘদিনের। এক্স-রে মেশিন নষ্ট। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় অপারেশন থিয়েটার কয়েক বছর ধরে বন্ধ। নোংরা টয়লেট। ভেতর-বাহির সবখানেই অপরিচ্ছন-দুর্গন্ধময়। নামে ৫০শয্যাবিশিষ্ট হলেও সবকিছুই চলছে ৩১ শয্যার কাঠামোতে। তাও পরিপূর্ণ নেই কোনো কিছুই। নিয়ম অনুযায়ী চিকিৎসকসহ ৭৮টি পদের মধ্যে বর্তমানে জনবল আছে মাত্র ৩৮জন। যুগ যুগ ধরে এমন অব্যবস্থাপনায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। যার ফলে, কাঙ্খিত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে উপকূলীয় এই জনপদের দেড় লক্ষাধিক মানুষ।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এতো বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য কাগজে-কলমে ৮জন চিকিৎসক থাকলেও প্রকৃত পক্ষে রয়েছে মাত্র পাঁচ জন। এদের মধ্যে ডা. সিরাজুল ইসলাম খাঁন এক বছর ধরে খুলনা র‌্যাব-৬ এর কোভিড ইউনিটে, ডা. আসিফ আদনান বাগেরহাট সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং প্রায় দুই বছর ধরে ডা. সবুজ মিয়া (হোমিওপ্যাথী) মঠবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রেষণে রয়েছেন। এছাড়া, বর্তমান পাঁচ জনের মধ্যে ডা. প্রিয়গোপাল বিশ্বাস এবং ডা. নাদিয়া নওরিনের পদায়ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। আর ডা. এস এম ফয়সাল আহমেদ ধানসাগর ইউনিয়ন এবং ডা. আরিফুল ইসলাম রাকিব খোন্তাকাটা ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকলেও চিকিৎসক সংকটের কারণে তারা বসছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই। এছাড়া, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. ফরিদা ইয়াসমিন রয়েছেন প্রশাসনিক দায়িত্বে।

চিকিৎসকরা জানান, প্রতিদিন শত শত রোগীর চাপ সামলাতে হচ্ছে তাদের চার জনকেই। প্রত্যেকের চেম্বারের সামনে রোগীর দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। দিন-রাত সমানে রোগী দেখতে গিয়ে বিশ্রামের সময়ও পাচ্ছেন না তারা। ৫০শয্যার চারটি ওয়ার্ডে নিয়মিত রোগী ভর্তি থাকে ৭০ থেকে ৮০জন। ওয়ার্ড এবং আউটডোরে এতো রোগীর চাপ নিতে না পেরে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তাছাড়া, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় এখানে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রাথমিক চিকিৎসার পর বাগেরহাট, খুলনা পাঠানো হচ্ছে জটিল রোগীদের।


বৃহস্পতিবার (২সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা থেকে দুপুর পর্যন্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে দেখা যায়, ওয়ার্ডগুলোতে করোনা, ডেঙ্গু, নিউমোনিয়া, জ্বর, সর্দি-কাশি, মারামারি, দুর্ঘটনায় আহতসহ নানা ধরণের রোগীতে ঠাসা। ওয়ার্ডে বেড না পেয়ে অনেকেই ঠাঁই নিয়েছে বারান্দায়। আউটডোরেও রোগীর দীর্ঘ লাইন। উপজেলার দক্ষিণ রাজাপুর গ্রাম থেকে প্রায় ১৫কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সকাল ৭টার সময় এসেছেন হাজেরা বেগম (৫৫) এবং জামিরোন বেগম (৪৫) নামের দুই নারী। রোগী চাপে তারা যেতে পারেননি ডাক্তারের কাছে। ক্লান্ত হয়ে বসে আছেন চেম্বারের সামনে সেই সকাল থেকে তিন-চার ঘন্টা যাবৎ।


শরণখোলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিসংখ্যান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ৭০দশকে প্রতিষ্ঠিত হয় ৩১শয্যার এই হাসপাতালটি। এর পর ২০১২ সালে উন্নীত হয় ৫০শয্যায়। ভবন, অবকাঠামো ও চিকিৎসা যন্ত্রপাতি সকবিছু ৫০শয্যা হিসেবে থাকলেও চিকিৎসক-জনবলসহ অন্যান্য সুবিধা ৩১শয্যারও কম।


পরিসংখ্যান বিভাগ জানায়, নিয়ম অনুযায়ী ৫০শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ইউএইচএফপিও সহ, ২৬জন চিকিৎসক থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে আছে মাত্র পাঁচ জন। এর মধ্যে সার্জারি, গাইনী, মেডিসিন, অ্যানেস্থেসিয়া বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট পদগুলো সব সময়ই শূন্য রযেছে। ২৭জন নার্সের স্থলে আছে ২৩জন। প্যাথলজিস্ট দুইজনে আছে এক জন, ওয়ার্ডবয় তিন জনে এক জন, বাবুর্চি দুই জনে একজন, উপসহকারী কমিউনিটি অফিসার ছয় জনে পাঁচ জন, ড্রাইভার দুই জনে একজন এবং সুইপার পাঁচ জনে আছে মাত্র এক জন। তিন জন ফার্মাসিষ্ট, দুই জন আয়া, এক জন মালি পদে কোনো লোকই নেই।

এছাড়া, অপারেটর থাকলেও এক্স-রে মেশিনটি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে অকেঁজো হয়ে পড়ে আছে। এনেস্থেসিস্ট ও গাইনোকোলজিস্ট না থাকায় অপারেশন থিয়েটারটি (ওটি) বন্ধ রয়েছে প্রায় চার বছর ধরে। ওটি ব্যবহার না হওয়ায় অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। দুইটি অ্যাম্বুলেন্সের একটির চালক না থাকায় সেটিও পড়ে আছে। কোনো ওয়ার্ডের টয়লেট ব্যবহার উপযোগী নেই। পয়নিষ্কাশনের ড্রেনগুলো উপচে পড়ছে। পুরো হাসপাতাল ক্যাম্পাস ময়লা-আবর্জনায় ভরা। সুইপার না থাকায় নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। ফলে ভেতর-বাহির সবখানেই দুর্গন্ধে দম আটকে আসা অবস্থা। এমন নোংরা পরিবেশে বাধ্য হয়েই থাকছে রোগীরা।


স্বাস্থ্য কমেপ্লক্সের আবাসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. এস এম ফয়সাল আহমেদ বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, আমরা এতো চাপ আর নিতে পারছি না। এখন আমরাই অসুস্থ হয়ে পড়ছি। ওয়ার্ড-আউটডোর মিলিয়ে প্রতিদিন দুই-তিন শ রোগী সামলাতে হচ্ছে আমাদের। মাত্র চার জন ডাক্তারের পক্ষে এটা কোনোভাবেই সম্ভব না। পর্যাপ্ত ডাক্তার না দিলে চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. ফরিদা ইয়াসমিন বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, ৫০শয্যার যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সুবিধা থাকা সত্বেও জনবল সংকটের কারণে সঠিক সেবা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এনেস্থেসিস্ট ও গাইনোকোলজিস্ট না থাকায় অপারেশন থিয়েটার বন্ধ রয়েছে। গত ১৫জুলাই চিকিৎসক ও জনবল চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করা হয়েছে।


বাগেরহাট জেলার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. মো. হাবিবুর রহমান বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, দীর্ঘ বছর ডাক্তার নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। জনবল নিয়োগও একটা বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়। সরকার নিয়োগ দিলে চাহিদা অনুযায়ী জনবল দেওয়া হবে। তাছাড়া, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে যারা প্রেষণে আছেন তারা আগের স্থানে ফিরে যাবেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত