মুক্তিসংগ্রামের মোহনায়

শান্তনু রানা

আপডেট : ০৪:২৫ পিএম, শনিবার, ৫ মার্চ ২০২২ | ১০৮৭

মার্চ মাস এলেই ইতিহাস মনে পড়ে। দেশ বিভাগের পর ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার জন্যে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার ধারাবহিকতায় বাংলাদেশর স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালে।

দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চক্রান্ত চলতে থাকে। ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর ফলে তুমুল প্রতিবাদ ধ্বনি উচ্চারিত হয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণার পর ভাষা আন্দোলন জোরদার হতে থাকে।

প্রথমে ছাত্ররা এ আন্দোলন চালিয়ে নিলেও পরবর্তীতে গোটা দেশবাসী ছাত্রদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। ফলে ছাত্রদের মনোবল বেড়ে যায় এবং তারা এগোতে শুরু করে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানে প্রত্যয়ী ছাত্রসমাজ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মিছিল বের করে। পুলিশ মিছিলের উপর গুলী চালায়। এতে সালাম, বরকত, রফিক ও জববারসহ অনেকে নিহত হয়। এ হত্যাযজ্ঞে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। এ স্মৃতি ভাষা আন্দোলনকে অক্ষয় করে রেখেছে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত হত্যাকান্ডের খবর সারাদেশে পৌঁছে যায়। অতঃপর পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা দেবার জন্য যারা উদ্যোগ গ্রহণ করেন তারা হলেন; কানাডায় বসবাসরত একটি বহুজাতিক ভাষাপ্রেমী গ্রুপ ‘মাদার ল্যাংগুয়েজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর ভিন্নভিন্ন ভাষাভাষী দশ জন সদস্য। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, এই দশ জন সদস্যের মধ্যে বাংলা ভাষাভাষী যে দুইজন ব্যক্তি ছিলেন তাদের নাম দুই অমর ভাষা শহিদেরই নাম রফিক ও সালাম।

এই গ্রুপটি ১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালনের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে একুশে ফেব্রুয়ারিকে এই দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রাদানের প্রস্তাব করে। জাতিসংঘ থেকে জানানো হয়, বিশেষ কোনো গোষ্ঠী নয়, বরং বাংলা ভাষাভাষী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব উত্থাপন করা সমীচীন। অতঃপর ভাষাপ্রেমিক জনাব রফিকুল ইসলাম এবং জনাব আব্দুস সালাম বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করেন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা'র বলিষ্ঠ নেতৃত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২৮ অক্টোবর, ১৯৯৯ তারিখে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর ঘোষণাপত্রটি ইউনেস্কোর সদর দফতরে পৌঁছে দেয়।

বাংলাদেশের এই প্রস্তাবের পক্ষে ২৮টি দেশ লিখিত সমর্থন জানায়। ইউনেস্কোর টেকনিক্যাল কমিটি কমিশন-২ এ প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয় ১২ নভেম্বর ১৯৯৯ তারিখে। সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রায় ৩০০ প্রতিনিধির সমর্থন লাভ করে প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্যতার স্বীকৃতি পায়। এরপর ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতির মাঝে যে চেতনার উন্মেষ হয়, তার চরম বিস্ফোরণ ঘটে ঊনসত্তর থেকে একাত্তরে। একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য শহীদ দিবস পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা বাঙালির জাতীয় জীবনের সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের সমস্ত আন্দোলনের মূল চেতনা একুশে ফেব্রুয়ারি। তখন থেকেই বাঙালি উপলব্ধি করেছিল তার বাঙালি জাতীয়তাবোধ, তার সংস্কৃতির অতন্দ্র প্রহরী।

এই সংগ্রামী চেতনাই বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং রাজনৈতিক আন্দোলন এই দু'ধারাকে একসূত্রে গ্রথিত করে মুক্তিসংগ্রামের মোহনায় এনে দিয়েছে। আর এই পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে।

একারণে একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। একুশের চেতনাই বাঙালি জাতিকে দিয়েছে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, শোষণের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামের প্রেরণা। ভাষা আন্দোলন জাতীয়তাবাদের প্রথম উন্মেষ। আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল ছিল বাঙালি জাতির আপন সত্তার উপলব্ধি এবং ঐক্যবদ্ধ হবার প্রেরণা। এ আন্দোলনই বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার আন্দোলনের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই বাঙালিদের মাতৃভাষার উপর চরম আঘাত হানে।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হলেও মূলত ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাঙালি জাতি আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়। ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব এখানে যে এর মাধ্যমেই এ প্রদেশের মানুষ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী শিক্ষা লাভ করে। এ আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শাসকচক্রের প্রতিটি ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়।

১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে প্রেরণা দিয়েছে একুশের ভাষা আন্দোলনের রক্তরাঙ্গা ইতিহাস। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে তাই ভাষা আন্দোলনের ফল বলা যায়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে গৃহীত হওয়ার ব্যাপারটি বাংলাদেশের জন্য যেমন অত্যন্ত গৌরবের। তেমনি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব অতীতের সেই চেতনাকে লালন করে আগামী পথে চলা। আমরা, আমি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বাংলা চেতনাকে জাগিয়ে রাখবো। একবিংশ শতাব্দিতে এটা হোক অঙ্গীকার।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত