দি ঢাকা আরবান কো-অপারেটিভ ব্যাংক

পাঁচ‘শ গ্রাহকের ২০ কোটি টাকা আত্নসাত

স্টাফ রিপোর্টার

আপডেট : ০৭:৩০ পিএম, শুক্রবার, ২৪ নভেম্বর ২০১৭ | ১০৫২

দি ঢাকা আরবান কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান বাগেরহাটের পাঁচ শতাধিক গ্রাহকের অন্তত ২০ কোটি টাকা আতœসাত করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও কর্তৃপক্ষ এসব গ্রাহকদের জমা রাখা টাকা ফেরৎ তো দিচ্ছেই না উল্টো তাদের বাড়াবাড়ি না করার হুমকি দিচ্ছে। তৎকালিত দায়িত্বরত ব্যবস্থাপক ওই টাকা আত্নসাত করে পালিয়ে গেছে বলে দাবি করছে কর্তৃপক্ষ। এদিকে, বাগেরহাট শহরের প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত দি ঢাকা আরবান কো অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করলেও স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী কোন সংস্থার কাছে প্রতিষ্ঠানটির কোন তথ্য নেই বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার।

জানা গেছে, দি ঢাকা আরবান কো অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড নামের এই প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. মোশারফ হোসেন চৌধুরী। তার বাড়ি পিরোজপুর জেলার শিকারপুর গ্রামে। ২০১২ সালে বাগেরহাট শহরের সাধনার মোড়ে সফি মার্কেটের তিনতলা ভাড়া নিয়ে দি ঢাকা আরবান কো অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডের নামে একটি প্রতিষ্ঠান সাইবোর্ড ঝুলিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৬৯ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি সমবায় থেকে নিবন্ধন পায়। (নিবন্ধন নং ৭১০) বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিষ্ঠানটির ৩৪টি শাখা রয়েছে বলে তাদের একটি প্রকাশনা থেকে জানা গেছে।

শুক্রবার দুপুরে দি ঢাকা আরবান কো অপারেটিভ লিমিটেডের ৩০/৩৫ জন গ্রাহক (অর্থ লগ্নিকারী) বাগেরহাট প্রেসকাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে এসব অভিযোগ তুলে ধরেন। এই গ্রাহকদের মধ্যে ব্যবসায়ি, শিক্ষক, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার লোক রয়েছেন। এরমধ্যে এফডিআর গ্রাহকের সংখ্যাই ১১৫ জন। এরা একেকজন ৫০ হাজার টাকা থেকে ১৫ লাখ পর্যন্ত টাকা জমা রাখেন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাগেরহাট শহরের পত্রিকা ব্যবসায়ি ও ওই প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক মোকাদ্দেস আলী।

তিনি লিখিত অভিযোগে বলেন, পাঁচ বছর আগে বাগেরহাট শহরের সাধনার মোড়ে সফি মার্কেটের তিন তলা ভাড়া নিয়ে দি ঢাকা আরবান কো অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডের নামে একটি প্রতিষ্ঠান সাইবোর্ড ঝুলিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। তারা টাকা সঞ্চয়ের (এফডিআর, ডিপিএস) নামে বিভিন্ন আকর্ষণীয় মুনাফার লোভ দেখিয়ে গ্রাহকদের প্রলুব্দ করতে বাগেরহাটের বিভিন্ন পেশার মানুষদের মাঝে প্রচারণা শুরু করে। এরমধ্যে ফিক্সড ডিপোজিটে এক লাখ টাকা জমা রাখলে মাসে দুই হাজার টাকা করে লভ্যাংশ দেওয়ার প্রলোভন দেয়। তাদের পাতা ফাঁদে পা দেয় বাগেরহাটের বিভিন্ন পেশার কয়েকশ গ্রাহক। দি ঢাকা আরবান কো অপারেটিভ লিমিটেড নামের ওই প্রতিষ্ঠানটি সরকারের অনুমোদিত না বুঝতে পেরে গ্রাহকরা তাদের জমা রাখা টাকা ফেরৎ চাইতে শুরু করলে ওই প্রতিষ্ঠানের তৎকালিন ব্যবস্থাপক নিহার রঞ্জন হালদার এলাকা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে চলে যান। পরে গ্রাহকরা তাদের জমা রাখা টাকা ফেরৎ পেতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করি। ওই সময়ে বাসুদেব দে নামে এক গ্রাহক ওই প্রতিষ্ঠানের তৎকালিন ব্যবস্থাপক নিহার রঞ্জন হালদারকে ভারত থেকে ধরে এনে বাগেরহাট জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে সোপর্দ করলেও তারা তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে ছেড়ে দেয় বলেও অভিযোগ করেন প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকরা।

তিনি আরও বলেন, দি ঢাকা আরবান কো অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড নামের এই প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. মোশারফ হোসেন চৌধুরী। তার বাড়ি পিরোজপুর জেলার শিকারপুর গ্রামে। তিনি সম্প্রতি তার প্রতিষ্ঠানের স্বাধীন শেখ নামে এক কর্মচারিকে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব দিয়েছেন। শহরের সাধনার মোড় এলাকা থেকে অফিস সরিয়ে বর্তমানে দশানী এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে বসে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। গ্রাহকরা তাদের পাওনা টাকা ফেরৎ চাইতে গেলে বর্তমানে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা বলছেন আগের ব্যবস্থাপক টাকা আতœসাত করে চলে গেছেন। তাই আমরা তোমাদের কোন টাকা ফেরৎ দিতে পারব না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। এই নিয়ে মামলা বা বাড়াবাড়ি না করতে হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ গ্রাহকদের।

বাগেরহাট শহরের পত্রিকা ব্যবসায়ি ও ওই প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক মোকাদ্দেস আলী বলেন, লাখে প্রতিমাসে দুই হাজার টাকা করে মুনাফা পেতে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি প্রথমে এক লাখ টাকা জমা রাখি। এর দুই মাস পর আরও দুই লাখ নিয়ে মোট তিন লাখ টাকা জমা রাখি। আমি টাকা জমা রাখার প্রথম চার মাসে মোট ২৪ হাজার টাকা লভ্যাংশ পাই। এরপর কর্তৃপক্ষ লভ্যাংশ দিতে নানা টালবাহানা শুরু করে। আমার দেখা দেখি অনেকেই এখানে তাদের টাকা এখানে জমা রাখেন। আমরা কয়েকশ গ্রাহক মুলধন হারিয়ে এখন সর্বশান্ত। প্রশাসনের কাছে যেয়েও কোন প্রতিকার পাচ্ছিনা। তাই সরকারের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন এই গ্রাহক।

বাগেরহাট সদর উপজেলার পশ্চিম ডাঙ্গা গ্রামের হাসিব হাওলাদার বলেন, ২০১৬ সালে দুই দফায় ছয় লাখ জমা করি। এরপর আমার দেখাদেখি বোন শাহীনুর বেগমও তিন লাখ টাকা জমা দেয়। প্রথম ছয় মাস আমি মাসে লাখে দুই হাজার করে মুনাফা (লভ্যাংশ) পাই। কিছুদিন পরেই তারা টাকা দিতে টালবাহানা শুরু করলে আমি আমার জমা রাখা টাকা ফেরৎ চাই। তাদের প্রলোভনে পড়ে আমরা শতশত গ্রাহক কয়েক কোটি টাকা তাদের দিয়ে আমরা এখন সর্বশান্ত হয়ে পড়েছি। এই টাকা ফেরৎ পেতে চলতি বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর আমি বাগেরহাটের অতিরিক্ত মূখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে একটি মামলা করি। মামলাটি বিচারক আমলে নিয়ে তা তদন্ত করতে জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে দায়িত্ব দেয়। পুলিশ এখনো তাদের তদন্ত শেষ করতে পারেনি বলে অভিযোগ তার।

এ প্রসঙ্গে জানতে দি ঢাকা আরবান কো অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড নামের এই প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. মোশারফ হোসেন চৌধুরীর (০১৭৬৪৬৮৮৪৮৪) নাম্বারে যোগাযোগ করলে এক নারী নাম্বারটি রিসিভ করে র্সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে লাইনটি কেটে দেন।

অভিযোগ অস্বীকার করে বাগেরহাটের পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায় বিকালে এই প্রতিবেদককে বলেন, অর্থ লগ্নিকারী কোন প্রতিষ্ঠান বৈধ অনুমতি নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আামার কিছু জানা নেই। তবে ক্ষতিগ্রস্থরা আমার কাছে আসলে আমি তাদের আইনী সহযোগিতা করব।

বাগেরহাটের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক বলেন মোহাম্মদ মামুন-উল-হাসান বিকালে এই প্রতিবেদককে বলেন, কোন অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ব্যাংকিং কোন কার্যক্রম চালালে কেন্দ্রীয় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি না নিয়ে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারবে না। এই প্রতিষ্ঠানটির কি অনুমতি আছে বা তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে আমরা অবহিত নই।

হুমকি দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে দি ঢাকা আরবান কো অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডের বাগেরহাট শাখা ব্যবস্থাপক মো. স্বাধীন বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা তৎকালিন ব্যবস্থাপক নিহার রঞ্জন হালদার প্রায় তিন শতাধিক গ্রাহকের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা নিয়েছেন। তবে তা আমাদের এখানে জমা না করে নিজে আতœসাত করেছেন। তিনি ২ কোটি ৫৩ লাখ টাকার কোন হিসাব দেখাতে পারেননি। এই টাকার হিসাব চাইলে তিনি গত আগষ্টে পালিয়ে যান। এরপর থেকে তিনি লাপাত্তা। চলতি বছরের ২৯ মার্চ বাগেরহাটের প্রতারিত গ্রাহকরা তাদের মূলধন ফেরৎ পেতে আমাকে ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে বসিয়েছেন। আমি ইতিমধ্যে ২১৫ জন গ্রাহককে অন্তত ১৫ লাখ টাকা ফেরৎ দিয়েছি। পর্যায়ক্রমে অন্যদের টাকাও ফেরৎ পাইয়ে দিতে কাজ করছি। আমি এই দায়িত্বে থাকলে সবার টাকা ফেরৎ দিতে পারব বলে দাবি করেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত