কবে পাবে তারা শ্রমিক কল্যাণ ভাতা বা ভবিষ্যত তহবিল এবং বীমা সুবিধা

আসলেই তারা অনেক কষ্ট করে

নাজমুল হুদা মিঞা

আপডেট : ০৪:১৪ পিএম, মঙ্গলবার, ২৩ জুন ২০২০ | ১৫৪২

ফাইল ফটো

গত দু'দিন গাছ টানানোর কাজে করাত কল মানে সমিলে গিয়ে বেশ কয়েক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। বলে রাখি, গাছ টানানো মানে গাছ ঝুলানো নয়। গোল কাঠ বা কাঠের গুড়ি বা লগ ফেড়ে বা কেটে বা চেরাই করে সাইজ কাঠ বা খুঁটি, চৌকাঠ, তক্তা, কাছপাইড়, চটা ইত্যাদি তৈরি করা বা রূপান্তর করাকে আমরা বাগেরহাট অঞ্চলে গাছ টানানো বলি। আমি আগে কখনো কাঠ চেরাই দেখিনি বা কাঠ চেরাই সংক্রান্ত কাজ করিনি ব্যাপারটা এমন নয়। তবে আগে এ কাজে আমার কোন কর্মচারী বা ঠিকা মিস্ত্রীকে দাঁড় করিয়ে দিয়েই আমি খালাস! অত সময় সমিলে কে দাঁড়িয়ে থাকে! নিজ কাজে চলে যেতাম, যত দ্রুত সম্ভব। এবার আমাদের ঠিকা মিস্ত্রীর ফুস মন্তরে আমি প্রায় দু'দিন সমিলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কাটিয়ে দিলাম! সময় কী কভু বৃথা যায়! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সমিল কর্মীদের যদি কাছ থেকে না দেখতাম, তাহলে জীবনের অন্য একটি দিক বা প্রকৃত জীবন সংগ্রাম কী দেখতে পেতাম! দেখতে কী পেতাম, ওরা কষ্টকর এই কাজ কিভাবে সহজ করে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা চালিয়ে যায়! দেখতে কী পেতাম, ওদের সহমর্মিতা! অপেক্ষাকৃত দুর্বল সহকর্মীকে সরিয়ে দিয়ে যেচে সে দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়া কী একদম কাছ থেকে দেখতে পেতাম! তবে কাজের মধ্যেই এরা দারুণ এক রোটেশন প্রথা কার্যকর করে একেক জনকে বিশ্রাম দেয়। যা বলছিলাম, কাঁধ, হাঁ, কাঁধ...স্কন্ধ...ঘাড়ই এদের প্রধান শক্তি, আমি বলি, হাতিয়ার। এরা ঘাড় ব্যাবহার করে সারাদিন কী হাড়ভাঙ্গা খাটুনিটা খাটে! আমাদের ঠিকা মস্ত্রী লোকটি আমাদের খুবই কাছের।

তার বাবা বা বড়ভাইও আমাদের খুব কাছের মামুষ। তারা সময় অসময়ে কখনো কখোনো টাকা-পয়সা না নিয়ে, স্রেফ বেগার খেটে আমাদের কত কাজ যে উঠিয়ে দিয়েছে, তার ইয়াত্তা নেই। কিন্তু সে এ কদিন বিশেষ কাজে ব্যস্ত বিধায় আমাকে সময় দিতে পারলো না। গতকাল সকালে সমিলে এসেই মাপজোকের বিষটা তদারকি করে এবং আমাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে চলে গেল। আমার কর্মচারীর সংখ্যা এখন আগের চেয়ে কমে গিয়েছে। তাছাড়া ওদের অন্যান্য জরুরী কাজ থাকায়, আমাকে মিস্ত্রী যে পরামর্শ দিয়েছে অর্থাৎ "কাঠ চেরাই চলাকালীন সমিল থেকে কোথাও এক পাও নড়া যাবে না", সেই একই পরামর্শ দিয়ে সে নিজ কাজে চলে গেল। এখন মিলে আমি আর আমার সাথে চেরাই করা কাঠ বাড়িতে নিয়ে আসার কাজে নিযুক্ত ট্রলিওয়ালা। আমি সমিলে দাঁড়িয়ে আছি, হাটছি, আবার বড়বড় কাঠের গুড়ি বা পেতে দেয়া টুলে বসছি। দীর্ঘ কাজ। বড় লগ গুলো ট্রলিতে (বড় চেরাই কল) প্রথম ব্যাম্পিস (সাইজ) করা হয়। তারপর ছোট মিলে এনে যেমন প্রয়োজন, তেমন কেটে নিতে হয়। এই সমিলটায় সাত-আট জন কর্মী। স্বভাবতই তারা সবাই খুবই কষ্ট সহিষ্ণু এবং শক্তিশালী লোক। তবে যতটুকু জানি, কঠোর পরিশ্রম করতে করতে খুব অল্প বয়সেই অনেকের শরীর ভেঙে যায়। আর শরীর ভেঙে যাবেই না কেন! এই কঠোর পরিশ্রমের পর তারা কি প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার জোটাতে পারে? তাদের বিষন্ন নিষ্পলক ভাবলেশহীন চোখেরা বলে দেয়, তারা পারে না। হাঁ, জীবনে তারা অনেক কিছুই করতে পারে না। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে তাদের সাথে গল্প জমাতে চেষ্টা করলাম। সত্যি বলতে, গল্প করার মত ফুরসত তাদের হাতে আছে কি? পাঁচ-দশ মিনিট সময় পরই বিদ্যুৎ চলে আসে।

আবার সবাই হুড়মুড়িয়ে কাজে লেগে পড়ে। তাছাড়া বিদ্যুতের বিকল্প ব্যবস্থা, মানে ডিজেল ইঞ্জিনের ব্যবস্থাও করাত কল মালিক করে রেখেছে। হয়তো যে কোন কারণে মিল চলছে না তো কী! বসে থাকার উপায় নেই। নৌকা বা ট্রলিতে করে যে লগ গুলো চেরাতে নিয়ে আসা হয়, সে গুলো উঠানো-নামানোর কাজ হাতে আছেই। সেগুলো করতে হয়। কাঠ উঠানো-নামানোর সময় এক দারুণ এক দৃশ্যের সূচনা হয়। সে সময় শব্দের অনন্য এক দ্যোতনাও সৃষ্টি হয়। তখন সবাই একযোগে কাজ করতে লেগে পড়ে। কয়েক জন গাছের সাথে কাছি বা রশী বিশেষ কায়দায় গিরা দিয়ে বাঁধে। তারপর, বোল, সুরে সুরে কী দারুণ সব বোল! এই বলরে বল, হেইয়োল্লোচ। আল্লারে বল, হেইয়োল্লোচ। আল্লাহ-বিধাতা-ভগবান, নারী-সৌন্দর্য-যৌনতা, সৃষ্টি রহস্য, আদিরস, অশ্লিলতা, বলতে গেলে সবকিছুই তাদের বোলের বিষয়বস্তু। তারা সুর করেকরে ছন্দবদ্ধ বিভিন্ন শ্লোক উচ্চস্বরে আওড়াতে আওড়াতে উজ্জীবিত হয় এবং "ঠেলার চোটে" কঠিন কাজটা সহজেই করে ফেলে। এবার একটু বৈষয়িক আলাপ-আলোচনা হয়ে যাক। ওরা দৈনিক বেতন-বাট্টা কত পায় শুনবেন? প্রধান মিস্ত্রীর দৈনিক বেতন পাঁচ শত থেকে ছয় শত টাকা। আর অন্যান্য সহকারীদের বেতন আড়াইশো থেকে তিন শত টাকা। চাকরির কোন নীতিমালা নেই। হায়ার এন্ড ফায়ার ভিত্তিতে এরা কাজ করে। তাহলে এত অল্প টাকায় এদের চলে কি করে? আমাকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে বলার যে মন্ত্রণা দেয়া হয়েছিল, তার সাথে এদের আর্থিক লাভালাভের একটা ঘোরতর সংযোগ আছে। কাঠ চেরাইয়ের পর উদ্বৃত্ত যে অংশ থাকে, যা লাকড়ি বা জ্বালানি কাঠ হিসাবে ব্যবহৃত হয়, সেই কাঠের মালিক সমিলের শ্রমিকরা। বলা হয়ে থাকে, তারা খেয়াল খুশী মত, কৌশল করে চেরাই করতে নিয়ে আসা কাঠ থেকে লাকড়ি বের করে নেয়। সত্যি বলতে মালিকদের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার রহস্য এখানেই।

আমি দু'দিন দাঁড়িয়ে থেকে যা দেখলাম, অন্যদের কাছ থেকে কি পরিমাণ কাঠ নেয় বা আমি দাঁড়িয়ে না থাকলে কী পরিমাণ কাঠ নিত, তা আমি জানি না, তবে আমার এখান থেকে খুব বেশী কাঠ তারা নেয়নি। কাজের লোড এবং আর্থিক লাভালাভের বিবেচনায় তা বলতে গেলে সামান্যই। সে কারণে আমি কাজ সেরে আসার সময় জানতে চাইলাম, "শোনা যায়, তোমরা চেরাই করতে নিয়ে আসা কাঠের অর্ধেকটাই তোমরা নাকি নিয়ে নাও!" প্রধান মিস্ত্রী শুনে হাসতে লাগলো। সে বলল," এটা কী সম্ভব! আমরা ধর্ম খাই না, স্যার। যেটুকু আপনার কোন কাজে লাগবে না, আমরা শুধু সেটুকুই নেই। আমার মুখটা কালো হয়ে গেল। আমি বিষন্ন মনে ভাবতে ভাবতে ফিরে চললাম, কবে সেদিন আসবে যেদিন সব শ্রমিক একটা অভিন্ন মজুরি কাঠামোর আওতায় কাজ করবে! কবে পাবে তারা শ্রমিক কল্যাণ ভাতা বা উপভোগ করবে ভবিষ্যত তহবিল এবং বীমা সুবিধা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত