প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় চলছে ব্যবসা

বাগেরহাটে মাদকের ভয়াল থাবা: শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে প্রত্যন্ত গ্রামে

শওকাত আলী বাবু

আপডেট : ১০:৫২ পিএম, রোববার, ১৪ জানুয়ারী ২০১৮ | ৪৩৭৮

সর্বনাশা মাদক এখন বাগেরহাট জেলা সদরসহ গ্রামগজ্ঞে আরো ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বগ্রাসী এ মরণ নেশার কারণে বাগেরহাট জেলার হাজার হাজার তরুন ও যুব সমাজ বিপথগামী হয়ে পড়ছে। তবে শুধু তরুণরা নয়, এখন কিশোর, এমনকি কিশোরীরাও মাদকাসক্ত হচ্ছে। সমাজ - সংসার সব কিছুই শেষ করে দিচ্ছে মাদকদ্রব্য। জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে এসকল উপকরন। ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের তরুণ ও যুব সমাজকে। মাদকের বিষাক্ত ছোবলে উৎকন্ঠিত অভিভাবকরা । তাদের চিন্তা কখন যেন মাদকের নেশার জালে আটকা পড়ে তার প্রিয় সন্তান।


বাগেরহাটে রবিবার এক মাদক সেবির হাতে প্রান হারাতে হয়েছে কচুয়ার এক নারীর। কচুয়া উপজেলার আড়িয়া মর্দন গ্রামের সিদ্দিক দীর্ঘদিন ধরে মাদকাসক্ত ছিলেন। রবিবার নিজেই তার স্ত্রী খাদিজা বেগমকে (২২) নির্যাতন করে মুখে বিষ ঢেলে হত্যা করেছে। বর্তমানে মাদক সেবি সিদ্দিক পলাতক রয়েছে। সিদ্দিকের প্রতিবেশী সেকেন্দার মোল্লার মতে, দীর্ঘদিন ধরে সিদ্দিক মাদকাসক্ত থাকায় সে প্রায়ই তার স্ত্রী খাদিজাকে মারধর করত। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার শালিস বৈঠক হলেও সিদ্দিক তার বউকে মারধর বন্ধ করেনি। অবশেষে খাদিজাকে মেরেই ফেলল।


শুধু খাদিজাই নয় এরকম অনেক নারীর জীবন বিশিয়ে তুলছে সর্বনাশা মাদক। প্রতিনিয়ন মাদকসেবী স্বামীর হাতে প্রত্যন্ত গ্রামের নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে। মাদক ব্যবহারকারীদের নানা অপরাধ সমাজ- সংসারে ঘটে চলছে অহরহ। খুন , ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ এমন কোন অপরাধ নেই যা সমাজে বসবাসকারী একজন মাদক সেবীদের পক্ষে করা সম্ভব নয় । গাঁজা ,মদ ,ফেন্সিডিল, ইয়াবা নামের মাদক ব্যবহারের ফলে মাদকসেবীরা শুধু নেশা গ্রস্থই নয় তারা হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে পড়ে। ফলে তাদের কাছে অপরাধ করা কোন অন্যায় বলে মনে হয়না। বর্তমানে টাকা হলেই বাগেরহাটে সর্বত্রই পাওয়া যাচ্ছে মাদক।

আগে মাদক বলতে গাঁজা ও দেশী মদই ছিল প্রধান উপকরন। এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আরোও অনেক নতুন নাম। বর্তমানে সবচেয়ে ভয়ংকর মাদক হচ্ছে ইয়াবা। শারীরিকভাবে এর তি মারাত্মক। ফেন্সিডিলের দাম বর্তমানে বেশি হওয়ায় বাগেরহাটের তরুন যুবকের কাছে ইয়াবার কদর বেশি। সহজে বহন যোগ্য ও প্রকার ভেদে দাম কম হওয়ায় বাগেরহাটে আশ পাশের জেলা থেকে দেদারছে ঢুকছে ইয়াবা। মাঝে মধ্যে পুলিশ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের দুই চারজনকে ধরলেও মূল হোতারা থেকে যায় ধরা ছোয়ার বাইরে।


বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট যাত্রাপুর পুরাতন রোড সহ একাধিক পথে ঢুকছে মাদক। পুরুষের পাশাপাশি মহিলাদের দিয়ে মটর সাইকেলে করে ইয়াবা পৌছে যাচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীদের হাতে। তাই শহরের পাশাপাশি এখন গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আশ্রয়ে মাদক ব্যবসা করছেন পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও।


এবিষয়ে রারুইপাড়া পুলিশ ক্যাম্পের এস আই বিশ^জিত কুমার বসুর সাথে কথা হলে তিনি বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের মাদক দ্রব্যসহ আটক করা হলেও তারা কিছুদিনপর বেরিয়ে এসে একই ব্যবসায় লিপ্ত হয়। গতবছরের নভেম্বর মাসে সবুজ বিশ্বাসকে মাদক সহ ধরা হয়। কিন্ত সে পরে জেল থেকে বেরিয়ে এসেছে। তার মতে ওই এলাকার অনেক ব্যবসায়ী সক্রিয় রয়েছে। যাদের ধরতে অভিযান পরিচালনার কথাও স্বীকার করেন তিনি।


বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের ব্যবসায়ী সিরাজ সেখ বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান দীর্ঘদিন ধরেই যাত্রাপুর, ফকিরহাটসহ আসপাশে ইয়াবার ব্যবসা চলছে। এখন থেকে বাগেরহাট শহর ও আশপাশের লোকজন এসে মাদক নিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে পুলিশ কয়েকজনকে ধরলেও পরে তারাই আবার এসে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় দাপটের সাথে মাদকের ব্যবসা চালাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা যেন অপরাধ। এই মাদক ব্যবসায়ীরা স্থানীয় তরুন ও যুব সমাজকে শেষ করে দিচ্ছে।

মাদক সেবনকারী ও ব্যবসায়ীদের সুত্রে জানা গেছে বাগেরহাটে বর্তমানে এক বোতল ফেন্সিডিল কম পক্ষে ৮শ টাকার নিচে পাওয়া যায়না। দামের তুলনামুলক কম ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় ফেন্সিডিলের জায়গা এখন দখল করছে ইয়াবা। বাগেরহাটের স্থানীয় ভাষায় ইয়াবার নাম বদলে রাখা হয়েছে বাবা। এই ইয়াবা নামের বাবা এখন তরুন যুবক এমনকি ছাত্রদের কাছে অতি পরিচিত হয়ে উঠেছে। এক একটি ইয়াবা প্রকার ভেদে ২শ টাকা আবার একটু উন্নত মানের হলে ৫শ টাকা থেকে ৬শ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে। তাই মাদক সেবনকারীদের কাছে ফেন্সিডিলের চেয়ে এখন কদর বেশি ইয়াবার।


বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কেউ দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে তার মধ্যে মানবিক গুণাবলি বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। খুন-খারাবিসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা তারা করতে পারে না। অথচ ভয়ংকর মাদক ইয়াবা এখন শহর থেকে বাগেরহাটে প্রত্যন্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিনিয়তই ঘটছে নানা সামাজিক অপরাধ। জানুয়ারী মাস জুড়ে মাদক প্রতিরোধে মাদক দ্রব্য অধিদপ্তরের পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনের সজাগ দৃস্টি । তবে বেশ আগে থেকে সমাজের গহীনে পৌছে যাওয়া মাদক নামের নানা উপকরনের ব্যবহার ঠেকানো যাচ্ছে না। সমাজের প্রভাবশালী এমনকি কোথাও কোথাও রাজনৈতিক দলের নেতারা অর্থ উপার্জনের জন্য সর্বনাশা মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ছে।


বিশেষজ্ঞদের মতে বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতিদিন হেরোইন, ইয়াবা, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক বিক্রি হয়। এর মধ্যে ইয়াবা বেশ সহজলভ্য । একপ্রকার ইয়াবা এখন মুুড়ি মুড়কির মতো বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট যাত্রাপুর, বালিয়াডাঙ্গা, চিলমারী ,শহরের খারদার , সোনাতলা, দশানী গ্রামসহ যেখানে সেখানে বিক্রি হচ্ছে।


ইয়াবা মূলত মিয়ানমার থেকে আসলেও এখন দেশের মধ্যেও মাদক ব্যবসায়ীরা ভেজাল ইয়াবা তৈরী করে তা বিক্রি করতেও ছাড়ছেনা। ভেজাল ইয়াবা কেনা বেচা নিয়ে প্রতারিত হলেও কোথাও নালিশ করার জায়গা নেই তাই অভিযোগ করেনা মাদক সেবিরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইয়াবা হেরোইনের চেয়েও তিকর। এটা এক ধরনের মনোউত্তেজক মাদক। ইয়াবা সেবনের ফলে সাময়িক শারীরিক উদ্দীপনা বাড়লেও কমতে থাকে জীবনীশক্তি। দেশ ও জাতিকে সুস্থ রাখতে হলে সর্বনাশা এ মাদকের কারবার জরুরি ভাবে বন্ধ করা দরকার।

অভিযোগ রয়েছে, সমাজের প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তি এসব সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাদের টিকিটি স্পর্শ করতে পারে না আইন-শৃখলা বাহিনী। দুঃখজনক হলেও সত্য মাঝে-মধ্যে বাগেরহাটে ছোটখাট মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকের চালান ধরা পড়লেও কুশীলবরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। অন্যদিকে মাদক ব্যবসায় যুক্ত থাকার অভিযোগে যাদের আটক করা হয়, তারাও কয়েক দিনের মধ্যেই জামিনে বেরিয়ে এসে আবার ওই কারবারে যুক্ত হয়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত