যেভাবে ফ্যাশন ডিজাইনার থেকে পোশাক রপ্তানিকারক হলেন তানিয়া

খোন্দকার নিয়াজ ইকবাল

আপডেট : ০৬:০৩ পিএম, বৃহস্পতিবার, ৫ আগস্ট ২০২১ | ১১৯২

ফ্যাশন ডিজাইনার তানিয়া তাছলিমা

ঢাকার তৈরি পোশাক শিল্প উদ্যোক্তা এবং রপ্তানিমুখি প্রতিষ্ঠান টুটি’স ক্রিয়েশনের সত্বাধিকারী তানিয়া তাছলিমা হতে চেয়েছিলেন ফ্যাশন ডিজাইনার। সেজন্য ভারতের বেঙ্গালুরুতে ফ্যাশন ডিজাইনিং-এর উপর উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসে ঢাকার শীর্ষস্থানীয় ফ্যাশন হাউজ কুমুদিনী-র চিফ ডিজাইনার হিসেবে কাজও শুরু করেন। কিন্তু পনেরো বছর পর এসে দেখা গেলো তিনি পরিণত হয়েছেন সফল একজন পোশাক রপ্তানিকারকে। কীভাবে সম্ভব হলো? সেই গল্পই করব আজ।

তানিয়া বিবাহসূত্রে কচুয়ার বধূ। তিনি কচুয়ার স্বনামখ্যাত সাংবাদিক, বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র সাংবাদিক আহরার হোসেনের স্ত্রী। কিন্তু আপন আলোতেই উদ্ভাসিত তিনি। মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে গত পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি গড়ে তুলেছেন একের পর এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

শৈশব থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় তার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থাতেই নাট্য প্রযোজনায় বিনিয়োগ করেন। তিনি তৈরি করতে শুরু করেন বিটিভির জন্য একের পর এক সফল ও দর্শকপ্রিয় নাটক। পরবর্তীতে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতের বেঙ্গালুরুতে পাড়ি জমান।

সেখান থেকে ফিরে রাজশাহীতে গড়ে তুলেন সিল্ক উৎপাদনের কারখানা। একই সাথে তিনি চিফ ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে যোগদান করেন কুমুদিনি হ্যান্ডিক্র্যাফ্টস লিমিটেডে। বাংলাদেশের বিখ্যাত দানবীর রনদা প্রসাদ সাহা, যাকে ১৯৭১ সালে একমাত্র ছেলেসহ হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদাররা, তার হাতে গড়া কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার সোসাইটির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান কুমুদিনী হ্যান্ডিক্র্যাফটস লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানের আওতায় আরো রয়েছে কুমুদিনী মেডিকেল কলেজ, ভারতেশ্বরী হোমস, কুমুদিনী নার্সিং কলেজ, রনদা প্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়, রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস, পাটকল, জাহাজ নির্মান প্রতিষ্ঠান আরো নানা উদ্যোগ যার আয়ের পুরোটাই ব্যয় হয় বাংলাদেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির সেবায়। এখানেই শহীদ রণদা প্রসাদ সাহার পৌত্র রাজিব প্রসাদ সাহা এবং পুত্রবধু শ্রীমতি সাহার ঘণিষ্ঠ সান্নিধ্যে কুমুদিনী হ্যান্ডিক্র্যাফটসকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তানিয়া। এসময় তিনি কাপড়ের ক্ষতিকারক ক্যামিকেল রঙের বিকল্প নিয়েও কাজ করছিলেন। পাশাপাশি তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগ হিসেবে রাজশাহী বিসিকে স্থাপন করেন সিল্ক মিল। চাকরির পাশাপাশি তিনি নিজের কারখানায় উৎপাদিত খাঁটি রাজশাহী সিল্ক সরবরাহ করছিলেন বাংলাদেশের নামকরা ফ্যাশন হাউজগুলোতে।

“সেসময় ঢাকার সবগুলো বড় ফ্যাশন হাউজই আমার কারখানার তৈরি সিল্কের কাপড় নিত”, বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলছিলেন তানিয়া।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে ওইসময় যেসব সিল্ক ব্যবহার করে সিল্কের জামাকাপড় তৈরি হতো তার বেশিরভাগ কাপড়ই আসতো ভারত থেকে চোরাচালান হয়ে। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে অল্প কিছু তাঁতী দেশি সিল্ক শিল্পটি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলেন। আমার ইচ্ছে ছিল তাদের সাথে কাজ করে বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার”।

ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়তে পড়তেই তানিয়া সান্নিধ্যে এসেছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেলের। তানিয়ার চিন্তার জগৎকে বদলে দিয়েছিলেন বিবি রাসেল। তানিয়া আজো বিদেশে তৈরি কোন পোশাক বিশেষ করে, ভারতীয় বা পাকিস্তানী কাপড়ের পোশাক পড়তে পারেন না।

তিনি বলেন, “আমার দেশে এত সুন্দর সুন্দর রঙের এত সুন্দর সুন্দর কাপড় আছে- আমার দেশের বেনারসী, তাঁত, জামদানী আছে – আমাকে কেন বিদেশি কাপড়ের পোশাক পড়তে হবে? বরঞ্চ আমার কাপড় আমি বিদেশিদের পরাবো।”

এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে তানিয়া গড়ে তোলেন ঢাকার শেওড়াপাড়ায় ছোট্ট কারখানা টুটি’স ক্রিয়েশন। সেখানে তিনি রাজশাহীতে তার নিজের কারখানায় তৈরি সিল্ক কাপড়ে ফিউশন করেন পশ্চিমা ডিজাইন। তৈরি করেন বাংলাদেশি ম্যাটেরিয়ালে তৈরি ওয়েস্টার্ন আউটফিট।

সারাদিন নারায়ণগঞ্জে কুমুদিনী হ্যান্ডিক্র্যাফ্টসে কাজ করতেন আর রাতের বেলায় ঢাকা ফিরে লেগে যেতেন নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে। ভোররাতে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে আবার রওনা দিতেন নারায়ণগঞ্জে।

তানিয়া বলেন, “টানা ছয় বছর আমি ঘুম কি জিনিস দেখিনি। আমি ঘুমাতাম শুধু ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার এবং আসার পথে গাড়িতে। ছোট বড় যে কোন স্বপ্ন বাস্তবায়নে পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই, তার প্রমাণ আমি আজ পেয়েছি”।

একই সময়ে তিনি পাটের তৈরি কাপড় নিয়েও গবেষণা করছিলেন। পাটের তন্তু দিয়ে তৈরি সুতা দিয়ে তাঁতে বোনা কাপড়ে ডিজাইন করেন শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, ওয়েস্টার্ন আউটফিট, ব্যাগ, ফ্যাশন জুয়েলারি ইত্যাদি। এসবের কালেকশন নিয়ে তিনি বিশ্বের নানা দেশে ফ্যাশন শো করে বেড়িয়েছেন। ফ্যাশন কালেকশন নিয়ে তিনি শো করেছেন আমেরিকা, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, আর ভারতের নানা শহরে। ঢাকার নামকরা সব ফ্যাশন শো’গুলোতে যোগ দিয়েছেন তিনি।

এক পর্যায়ে নিজের কারখানা বড় হয়ে উঠলে কুমুদিনীর চাকরিতে ইস্তফা দেন ২০১০ সালে। এসময় তিনি সরাসরি রপ্তানি করতে শুরু করেন জার্মানি, কানাডা, জাপান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও তুরস্কে।

করোনার মহামারির সময়ে তিনি প্রথম আমেরিকার সিডিসি অনুমোদিত কাপড়ের মাস্কের ডিজাইন করেন ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে। এসময়ে তিনি টানা ছয় মাস নিজের কারখানায় তৈরি পিপিই ও মাস্ক বিনা লাভে, শুধুমাত্র উৎপাদন মূল্যে বিতরণ করেছেন সারা বাংলাদেশে। আর চিকিৎসকদের তিনি পিপিই ও মাস্ক পাঠাতেন বিনামূল্যে।

তানিয়া স্বপ্ন দেখেন শিশুদের জন্য কিছু করবেন। এমন একটা সমন্বিত ব্যবস্থা তিনি গড়ে তুলতে চান যেখানে দরিদ্র ও পথশিশুরা বিনামূল্যে থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা ও কর্মমুখী শিক্ষা পাবে যাতে পরবর্তীতে তাদেরকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা যায়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত