দেশি শার্ট
আপডেট : ১১:২১ পিএম, রোববার, ২২ মে ২০২২ | ৯০২
কাগজের ব্যাগটি বাম হাতে ঝুলিয়ে ডান হাতে দোতালার সিঁড়ি ধরে বেয়ে ফুরফুর মেজাজে উপরে উঠে এলেন রহমান সাহেব। ডোর বেল টিপতেই মেজোবোন খায়রুন এসে দরজা খুলেই জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় গিয়েছিলে ?
এইতো একটু ডাকবাংলা বাজারে গিয়েছিলাম । কী ভ্যাপসা গরম ?
আয়,আয় ভিতরে আয়। সোফার উপরে বসবি নাকি খাটের উপর গা এলিয়ে দিবি ? ফ্যানটা চালু করে দেই ।
তোমাদের .কতবার বলেছি গরমের সময় আমাকে দেশে আসতে বলবে না। বাংলাদেশের গরমে আমি সেদ্ধ হয়ে যাই।
ঠিক আছে আর বলব না। এদিকে আয় । আমি ফ্যানটা অন করে দিচ্ছি। প্যান্ট শার্ট বদলিয়ে একটা লুঙ্গি পরে খাটের উপর শুয়ে গড়গড়ি দিয়ে বিশ্রাম কর। শরীরটা ঠাণ্ডা হবে ।
তোমার ছোট মাতবর কই ?
কে আরিফ ?
হ্যাঁ,আরিফ ।
মসজিদে আজকে আমাদের ইফতারি দেয়ার কথা আছে। ইফতারির কিছু সামগ্রী কিনবে বলে তোর দুলাভাইয়ের সাথে বাজারে গেছে । কেন কিছু বলবি নাকি ?
না,তেমন কিছু না।
ঠিক আছে । এখানে শুয়ে বিশ্রাম নে,ভাই । আমি রান্নাঘরের দিকে যাই। কিছু সোলা,বেগুনি ,পিয়াজু ভাজতে হবে । তোর দুলাভাই বলে গেছে সবকিছু যেন ইফতার টাইমের আধাঘন্টার পূর্বেই রেডি হয়ে যায় ।
ব্যাগটা পাশে রেখে রহমান সাহেব খাটের উপর শুয়ে পড়লেন । মাথার উপর ফ্যানটি ভোঁ ভোঁ শব্দে ঘুরতে লাগল ।
আরিফ ও তার বাবা কিছুক্ষণ পর বাজার থেকে ফিরলেন ।
বাজার থেকে কেনা ইফতার সামগ্রী নিয়ে আরিফ তার মায়ের কাছে রান্না ঘরে ঢুকতেই মা ডেকে বললেন ,আরিফ এসেছি, বাবা ?
জ্বী, মা । কেন ?
তোর মামা তোকে খোঁজ করেছিল ।
কেন ?
আমায় কিছু বলেনি।
কই সে ?
বেচারা গরমে অস্থির । আমি তোর রুমে শুইয়ে ফ্যান চালু করে রেখে এসেছি । যে গরম পড়েছে ফ্যানেও কাজ হয় না।
মামা আমেরিকায় থাকেতো শীতের দেশ । আমাদের দেশের গরমে তার কষ্ট হয় । আর এই ক’দিন গরমও পড়েছে । ১২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
দেখি বলে সে রান্নাঘর ত্যাগ করল ।
কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ফিরে এলো ।
মা জিজ্ঞেস করল , ফিরে আসলি যে ?
মামা ঘুমিয়ে পড়েছে । আমি তাকে জাগালাম না।
ঠিক আছে । ব্যাগ থেকে এগুলো তুলে আমাকে একটু সাহায্য কর,বাবা । ঘুম থেকে উঠলে কথা বলিস ।
আরিফের মামা রহমান সাহেব আমেরিকা থাকেন। প্রায় আধাযুগ পরে দেশে বেড়াতে এসেছেন । এর মধ্যে রোজাও এসে পড়ছে । দেশে এলে সে সব সময় বড় ভাইয়ের সংসারে উঠেন । বড় ভাইয়ের সঙ্গে তার মা-ও থাকেন । বাবা নাই । মায়ের কাছেই থাকতে তার পছন্দ। বড়ভাই রেলওয়েতে চাকরি করতেন । চাকরি শেষে অবসর জীবনটা বাগেরহাটে বাবার ভিটায়ই থাকেন। মেজোবোন স্বামী সন্তান নিয়ে খুলনার আরামবাগে থাকেন । তার মাত্র তিনটি ছেলে সন্তান। ভগ্নীপতি একজন ব্যাংকার । তিন ছেলে নিয়ে তারা সুখেই আছেন । গেল বছর স্বামী-স্ত্রী সৌদি গিয়ে হজ্বও পালন করে এসেছেন।
গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট থেকে কয়েক দিন হলো রহমান সাহেব খুলনায় বোনের বাড়ি এসেছেন ।
ইফতার সামগ্রী তোলা হয়ে গেলে আরিফ মাকে জিজ্ঞেস করল,আমি তোমায় ক’টা বেগুনি ভেজে দেই মা ?
না,হাত পোড়াবি । দেখ তোর মামা উঠছে নাকি ? একটা তালপাখা নিয়ে বাতাস করগে,যা । তালপাতার বাতাস খুব আরামদায়ক।
মামার কাছে এসে আরিফ তালপাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগলো । এরই মধ্যে তার ঘুমও ভেঙে গেল ।
আরিফ জিজ্ঞেস করলো,আমায় খোঁজ করছেন মামা ?
হ্যাঁ । বাজারে গিয়েছিলাম একটা শার্ট কিনলাম । দেখতো ক্যামন হয়েছে ? দোকানদার আমাকে ঠকিয়েছে কিনা? তোর তো ঐ এক কথা দোকানিরা আমায় শুধু ঠকায় ।
সব দোকানদাররা তো আমার শ্বশুর। আপনাকে ঠকাবে না তো কাকে ঠকাবে ? আরও প্রবাসী বেয়াই ।
হয়েছে ,হয়েছে খুলে দেখ বলে ব্যাগের দিকে আঙুল নির্দেশ করে দেখালো, ঐ যে ব্যাগে ।
ব্যাগ খুলতে খুলতে আরিফ জিজ্ঞেস করল,ঈদের সময় পাঞ্জাবি না কিনে শার্ট কিনলেন ?
হাতে তো সময় আছে পরে কিনব । পাঞ্জাবিও অনেকগুলো দেখেছিলাম পছন্দ হলো না ।
কেন ?
আমি চেয়েছিলাম পাঞ্জাবি বা শার্টের ট্যাগে মেইড ইন বাংলাদেশ লেখা থাকবে এমন একটা শার্ট বা পাঞ্জাবি কিনতে । তেমন পেলাম না। এই শার্টটায় পেলাম তাই নিলাম। প্রবাসে থাকলেও মনটা পড়ে থাকে বাংলাদেশে । তাই মেইড ইন বাংলাদেশ লেখা শার্ট প্যান্ট পরতে ভালো লাগে । দেশি দেশি গন্ধ আসে। আমেরিকার দোকানপাটে গেলে গার্মেন্টস সামগ্রী কেনার আগে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখি মেইড ইন বাংলাদেশ লেখা আছে কি না ? মেইড ইন বাংলাদেশ দেখলে গর্বে মনটা ভরে যায়। ওখানকার ওয়ালমার্ট,টার্গেট,স্যামস ক্লাব প্রভৃতি সুপার মার্কেটগুলোতে বাংলাদেশি গার্মেন্টস সামগ্রী পাওয়া যায়।
দাম কত নিয়েছে ?
সতের শ’ টাকা।
দাম শুনে আরিফ কপালে হাত তুলে বলল ,বলেন কি ? সতের শ’ টাকা?
চেয়েছিল তিন হাজার টাকা।
ঈদের বাজার বলে একটু বেশী হতে পারে। হাজার থেকে বারো শ’ উপরে নয় । তাই বলে সতের শ’ ? দোকানদার আপনাকে রীতিমত ঠকিয়েছে।
আমি তো জানি বাংলাদেশের দোকানদারেরা দাম একটু বেশি চায়। তাই অনেক শঙ্কা করে অর্ধেক মানে পনের শ’ বললাম। বলে কি এদামে তারা কিনতেও পারেন নাই। ভাবখানা এমন দেখালো যে পঁচিশ শ’র কমে দিবেন না। আমারও পছন্দ হয়েছে মেইড ইন বাংলাদেশ লেখা আছে। দু’ শ'বাড়িয়ে সতের শ'বললাম। তাতেও মোড়ামুড়ি করে পরে দিয়ে দিল।
কেনার আগে কী টের পেয়েছিলো আপনি একজন প্রবাসী ?
নাহ ! তবে মুখ ফসকে বেড়িয়ে গিয়েছিল ,হাউ মাচ ? মানে দাম কত?
আরিফ টেনে টেনে বলল আরে মামা ,ঘটনা তো ঐখানে । বাংলাদেশের দোকানদরা এখন সাড়ে হারামজাদা । পণ্যের গুণের মান অনুযায়ী দাম চায় না । দাম চায় কাষ্টমার বুঝে । প্রবাসী জেনেই আপনাকে এমন ঠকিয়েছে। আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি ?
জিজ্ঞেস করল আপনি কী বাইরে থাকেন ? বললাম হ্যাঁ, আমেরিকায় । মিথ্যে তো আর বলা যায় না । ক্যাশ বাক্সে যে লোক বসা ছিল মনে হলো মালিক বা মালিকের ছেলে। মুখে চাপ দাড়ি ।
বাংলাদেশে হিন্দু মুসলিম সবাই দাড়ি রাখে । কে মোদী পন্থী আর কে ইসলাম পন্থী কিছুই বোঝা যায় না ? দাড়ি রাখা আজকাল একটা ফ্যাশান ।
এমন সময় ব্যাগটার দিকে আরিফের নজর গেল ।
উচ্চ স্বরে বলল, দেখেন দেখেন মামা ,ব্যাগের গায়ে লেখা ‘ মা লক্ষ্মী বস্ত্রালয়।‘ এটা কি মুসলমানদের দোকান ? খরিদ্দার ঠকাতে এরা ইসলামিক রীতি অনুযায়ি সম্ভাষণও আদান প্রদান করে। এটা শুধু হিন্দুদের বেলায় নয়। প্রতিটা ব্যবসাসীয়ই এক ধাঁচের । এরা সুযোগ পেলেই খরিদ্দারের সাথে প্রতারণা করে । ‘ সততাই আমাদের মূলধন ‘ এই সাধুবাদটি আজ বাংলদেশ থেকে নিরুদ্দেশ।
কোন সমস্যা নেই । কাল বিকেলে আমরা খুলনা নিউ মার্কেটে গিয়ে আপনার জন্য শার্ট কিনে আনব । সেখানে অনেক নামিদামি দোকান আছে । দোকানগুলোতে বিদেশি কোয়ালিটির ভালো ভালো গার্মেন্টস সামগ্রী পাওয়া যায় ।
পরিকল্পনা অনুযায়ী পরের দিন বিকেলে মামা ভাগ্নে নিউ মার্কেটে গিয়ে পৌঁছিল । রিকশায় যেতে যেতে আরিফ তার মামাকে বলল, ‘দোকানে গিয়ে আপনি এমন কথা বলবেন না যেন ওরা বুঝতে পারে আপনি প্রবাসী । বার্গেনিং যা করার আমি করব। আপনি শুধু পছন্দ অপছন্দের মতামত আমাকে জানাবেন।’
নিউ মার্কেটের নিচতলা ঘুরে ঘুরে প্রথমে কয়েকটা দোকান দেখল । কোন দোকানেই পছন্দের শার্ট পেলনা । অবশেষে আরিফ বলল,চলেন দোতলায় যাই । দোতালায় খুলনা ফ্যাশন নামের বিশাল বড় একটা দোকান আছে । সেখানে দেশ-বিদেশের হরেক রকমের গার্মেন্টস সামগ্রী পাওয়া যায় ।
খুলনা ফ্যাশনে ঢুকতেই দু’জন সেলসম্যান তাদের দিকে এগিয়ে এসে বললো,আমাদের প্রতিষ্ঠানে পদধূলি দেওয়ার জন্য আপনাদের স্বাগতম । আসুন বসুন ,আপনাদের কী খেদমত করতে পারি ?
দোকানের কাস্টমার প্লাট ফর্মের সামনে রাখা বসার টু্লে বসতে বসতে বসতে আরিফ বলল ,আমার মামার জন্য শার্ট কিনতে এসেছি । ভালো দেখে কিছু শার্ট দেখান তো ।
একজন সেলসম্যান জানতে চাইলেন, দেশি না বিদেশি ?
দেশি । তবে কোয়ালিটি ভাল হতে হবে ।
কোন সমস্যা নেই। আমাদের কাছে দেশি বিদেশি সব কোয়ালিটির ভালো মাল আছে ।
ঠিক আছে,দেখান বলল আরিফ।
সেলসম্যান টপাটপ করে পাঁচ সাতটি শার্ট প্লাট ফর্মে ফেলে মামা ভাগ্নেকে দেখাতে লাগল । তার মধ্যে একটা ছিল গতকাল ডাকবাংলা বাজার থেকে কেনা ঠিক একই কোম্পানির । মামা সেটির দিকে নজর দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,এই শার্টটির দাম কত ?
দাম নিয়ে ভাববেন না। আপনার পছন্দ হয়েছে তো ?
এ সময় মামা আরিফের দিকে তাকালো। বোঝাতে চাইল এই শার্টই তো গতকাল ডাকবাংলা বাজার থেকে কেনা হয়েছে । এখানে কত চায় ?
আরিফ সেলসম্যানকে জিজ্ঞেস করল,এই শার্টটির দাম কত ? মামার বোধ হয় পছন্দ হয়েছে ।
শার্টের কাপড়টা বিদেশি । তৈরি দেশে । কোয়ালিটি খুব ভাল।এই কোম্পানীর মাল ইউরোপ আমেরিকায়ও রপ্তানি হয় ।
অন্য কোন কাষ্টমার হলে দাম নিতাম বারো শ’ টাকা । মামার যেহেতু পছন্দ হয়েছে বারো শ’ না একদাম এক হাজার টাকা রাখা যাবে।
আরিফ মামার দিকে তাকালো ।
একজন সেলসম্যান আরিফের সে তাকানো খেয়াল করে জিজ্ঞেস করলেন,কিছু বললেন ?
না,কিছু না। মামাকে বোঝাতে চাইল ডাকবাংলা বাজারে তিন হাজার টাকা চাও্য়া শার্ট দরকষাকষি করে কিনলেন সতের শ’ টাকায় । আর এখানে সেই একই শার্ট প্রথমবারেই ঠিক দিল মাত্র এক হাজার টাকায়।
আরিফ বলল,আর বলেন না ভাই ?
সেলসম্যান জিজ্ঞেস করলেন,কেন কী হয়েছে ?
আরিফ তখন গতকাল ডাকবাংলা বাজারে মামার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা বিস্তারিত বললো।
ক্যাশ বাক্সে বসে থাকা দোকানের মালিক আরিফের মুখে আদ্যপান্ত শুনে একজন সেলসম্যনকে ডেকে বললেন,উপরের তাকে রাখা মাল ক্রয়ের মেমোটা আনেন তো ? দেখি ঐ শার্টের ক্রয় মূল্য কত ?
মেমো দেখে বললো,এই শার্টের ক্রয় মূল্য পড়েছে নয় শত টাকা । মামা যেহেতু ডাকবাংলা বাজারে ঠকেছেন তাই তার সৌজন্যে এই শার্টটি পঞ্চাশ টাকা লাভে সাড়ে নয় শতে দিয়ে দাও । যদি কিছু লোকশন পুষিয়ে নিতে পারেন। বাপদাদার আমল থেকে আমাদের ব্যবসা এখানে নয়ছয় পাবেন না। খুলনার মধ্যে আমাদের প্রাইস গ্যারান্টেড । আমাদের চেয়ে যদি কোথাও কম দামে মাল পান আমরা সে প্রাইস ম্যাচ করব । মামা কী আর কিছু নিবেন ?
ঠিক আছে । আরও কয়েকটা শার্ট দেখান ।
সেখান থেকে বেছে বেছে কয়েকটা শার্ট কিনলেন।
একজন সেলসম্যান আরিফের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,আপনি কিছু নিবেন না ?
না আমি কিছু নিব না।
এ সময়ে মামা বললেন, কিছু একটা কেন ।
আমি শার্ট নিবনা। এখন ঈদের সময় ।এক সেট পাজামা-পাঞ্জাবি নিব।
অনেকগুলো সেটের মধ্য থেকে আরিফ একসেট শেরওয়ানী পাজামা-পাঞ্জাবি পছন্দ করল ।
ম্যানেজার বলল সেটটা খুবই সুন্দর। তবে বাংলাদেশি না, ইন্ডিয়ান।
পণ্যের মূল্য পরিশোধ করে মামা ভাগ্নে নিউ মার্কেট থেকে বেড়িয়ে অনেকগুলো রিকশার ভিড় থেকে একটি রিকশা ভাড়া করে বাসায় দিকে রওয়ানা দিল।
লেখকঃ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী
সাবেক সদস্য কচুয়া প্রেস ক্লাব