মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে ডেজিং প্রকল্প পরিদর্শনে এসে

গ্রামবাসীর তোপের মুখে ফিরে গেলেন নৌ-সচিব,বালুভরাট নিয়ে বিরোধ চরমে

মাসুদ রানা,মোংলা

আপডেট : ১১:১৫ পিএম, শনিবার, ২০ আগস্ট ২০২২ | ৪৩৬

মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে ড্রেজিং প্রকল্পের বালু ডাম্পিং নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বানিশান্তা গ্রামবাসি এখন মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রামের পর সরেজমিনে পরিদর্শনে আসেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রনালয়ের সচিব সহ একটি প্রতিনিধি দল, কিন্ত গ্রামবাসীর তোপের মুখে স্প্রিড বোর্ট থেকে নামতে পারলেন না তারা। কৃষি জমি নষ্ট করে ক্ষতিপুরণ না দিয়ে জোরপূর্বক বালু ডাম্পিং করবে বলে সাথে আনা সাইনবোর্ড দেখেই তেড়ে যান এলাকাবাসী, সামনেই করেন বিক্ষোভ, ছুড়তে থাকেন ইট-পাটকেল। এছাড়া জোর পুবর্ক দখলে নিলে বালু ঝড়ের আগ্রাসনে বসবাসের অনুপযোগি সহ পরিবেশের শংকায় চরম হতাশার মধ্যে রয়েছেন গ্রামবাসি। নৌ-পরিবহন মন্ত্রনালয়ের প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরির্দশনে আসলে, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার শহ¯্রাধিক নারী-পুরুষ বালু ডাম্পিংয়ের স্থানে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ জানালে নদী থেকেই ফিড়ে যান নৌ-সচিব সহ প্রতিনিধি দলটি।


বন্দর সুত্র জানায়, বন্দর উন্নয়নে আউটারবার ড্রেজিংয়ের পর এবার পশুর নদীতে ৭শ ৯৪ কোটি টাকা ব্যায় ইনার বার ড্রেজিংয়ের কাজ গত বছরের ১৩ মার্চ শুরু করে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। যার জন্য ১৫শ একর জমির প্রয়োজন হলে ৫শ একর সরকারী জমি ছাড়া মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ পশুর চ্যানেলের ড্রেজিংকৃত বালু-মাটি ফেলার জন্য চিলার জয়মনি এলাকার মালিকানা ৭শ একর জমি হুমুক দখলে নিয়ে বালু ডাম্পিং করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। আরো ৩শ একর জমি পশুর নদীর পশ্চিম পাড় দাকোপ উপজেলার বানিয়াশান্তা মৌজায় রয়েছে।


দাকোপের সেই ৩শ একর জমি বন্দর কর্তৃপক্ষ দখলে নেয়ার বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়। সেখানকার এলাকাবাসীর আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে সরেজমিনে পরিদর্শনে আসার জন্য শনিবার দিন ধার্য করে নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়। ২০ আগষ্ট সকাল সাড়ে ১১টায় বন্দরের নিজস্ব ডিফেন্ডার বোর্ট যোগে সেখানে যান মন্ত্রনালয়ের সচিব মোঃ মোস্তফা কামাল সহ মন্ত্রনালয়ের একটি প্রতিনিধি দল। সাথে ছিলেন বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মাদ মুসা, প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মোঃ শওকাত হোসন ও মন্ত্রনালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তা বৃন্দ।

শনিবার সকালে নৌ-পরিবহন মন্ত্রনালয়ের প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসার খবরে বানিয়াশান্তা ইউনিয়নের কয়েকশ’ গ্রামবাসী নারী পুরুষ সমবেত হয় সেখানে। এসময় তারা বন্দর কর্তৃপক্ষের জমি হুকুম দখলের সাইন বোর্ড দেখে তেড়ে যান কায়েকশ গ্রামবাসী। তাদেরকে উদ্দেশ্য করে ছুড়তে থাকেন ইট-পাটকেল এবং মন্ত্রনালয়ের প্রতিনিধি দলকে নদী থেকে কিনারে উঠতে না দিয়ে নদীর পারে তাদের সামনেই বিক্ষোভ করেন এলাকার নারী-পুরুষরা।

এসময় বিক্ষোভকারী এলাকাবাসী জানায়, এখন মৎস্য ও ধান চাষের মৌশুম চলছে, তাদের জীবন ধারনের জন্য মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে ও পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার একমাত্র সহায় সম্বল টুকু কেড়ে নিলে নিঃস্ব হয়ে পথে বসতে হবে তাদের। তাই তিন ফষলী কৃষি জমিতে জীবন বেঁচে থাকতে বালু ফেলতে দেয়া হবে না বলে জানায় তারা। তারা আরো বলেন, কিছু কুচক্রি মহল সরকারকে এ অঞ্চলের জমি অনাবাদী বলে ভুল তথ্য দিয়ে ড্রেজিংয়ের নামে আমাদের তিন ফসলীয় কৃষি জমি নষ্ট করার পায়তারা করছে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। নিয়ম ভঙ্গ করে অন্যায় ভাবে আমাদের উপর জুলুম করছে বন্দর, আমাদের জীবনে এক বিন্দু রক্ত থাকতে জমিতে বালু ফেলতে দিবোনা বলে উচ্চারণ করেন গ্রামবাসী।

গ্রামবাসীর অভিযোগ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে সবই দেখলাম সরকার কৃষি জমি নষ্ট করতে বলেনি তার পরেও যদি জোর পুর্বক দখলে নেয়ার চেষ্টা করে তবে এলাকার মানুষের লাশের উপর দিয়ে দখল করতে হবে। জীবন থাকতে কৃষি জমিতে বালু ফেলতে দেয়া হবে না।


বাংলাদেশ হিন্দু বৈদ্য-খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ বলেন, আমরা মোংলা বন্দরের উন্নয়ন চাই, কিন্ত কৃষি জমি নষ্ট করে নয়। ড্রেজিংয়ের বালু ফেলার জমি থাকতে কি কারণে আমাদের কৃষি জমি নষ্ট করা হচ্ছে তার কোন কুল কিনারা বুঝতে পারছিনা। আমরা আমাদের পৈত্রিক জমি রক্ষা করার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছি, তার পরেও যদি জোর পুর্বক জমি দখল করে বালু ফেলার চেষ্টা করা হয়, তা হলে কঠোর আন্দোলন করবে এ অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্থ্য মা-বোনেরা। বন্দর কর্তৃপক্ষ কৃষি জমিতে বালু ফেলার চেষ্টা করলে এ এলাকার মানুষের লাশের উপর দিয়ে বালু ফেলতে হবে বলে জানান তিনি।

দাকোপ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খান মুনসুর আলী বলেন, মোংলা বন্দর উন্নয়ন মানে সরকারের উন্নয়ন, সরকার যেখানে উন্নয়ন করবে সেখানেই আমরা সরকারকে সহায়তা করবো, কিন্ত এলাকার গরিব ও অসহায় মানুষদের মুখের খাবার কেড়ে নিয়ে, জীবনের তরে শেষ করে উন্নয়ন করা এটা কোন ভাবেই সম্ভব নয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ যা করছে তা সঠিক নয়, ড্রেজিংয়ের বালু ফেরার জন্য বহু খালী জমি রয়েছে, সেখানে বালু ফেললে একদিকে সরকারের উন্নয়নও হবে অন্য দিকে সরকারের গ্রহন করা প্রকল্পের টাকার সাশ্রয় হবে।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মাদ মুসা বলেন, দেশের একটি বন্দরকে সচল রাখতে হলে বন্দরের চ্যানেল সচল রাখতে হবে। ইতি পুর্বে বন্দরের চ্যানেলে নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় ৯০ দশকে বন্দরটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম ছিল। বর্তমান সরকার মৃত প্রায় বন্দরকে আবার উজ্জীবিত করেছে। পণ্য আমদানী-রপ্তানীতে বন্দর এখন দেশের একটি লাভ জনক প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছে। পশুর চ্যানেল ড্রেজিং সরকারের একটি বড় মেগা প্রকল্প, বন্দরকে সচল রাখতে হলে ড্রেজিংয়ের কোন বিকল্প নেই, তাই বালু ডাম্পিং করার জন্য সরকার যেখানেই ব্যাবস্থা নিবে আমরা সেখানেই বালু ফেলবো এ নিয়ে গ্রামবাসীর সাথে অহেতুক আমাদের কোন দন্ধ বা প্রতিবন্ধকতা সৃস্টি করার প্রয়োজন নাই। সরকারের প্রকল্প কি ভাবে সম্পুর্ন করবে সেটা সরকারই ব্যাবস্থা নিবে, তবে শনিবার দুপুরে নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়ের সচিব মহোদয় আসার পরে গ্রামবাসী তাদের কথাগুলো জানাতে পারতেন কিন্ত তা না করে বিশেষ একটি মহলের ইন্ধনে তারা যা করছে তা কোন রকমই সঠিক হয়নি।

দেশী-বিদেশী বানিজ্যিক জাহাজ নির্বিঘ্নে আসা-যাওয়ার জন্য ইনার বার ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। গত ১৩ মার্চ এ কাজের শুভ উদ্বোধন করেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রনারয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার। মোংলা বন্দরের এ মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ করতে ৭শ ৯৪ কোটি টাকা ব্যায় ধরা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত