ভাষা ও ভাষ্যবিদ্যা

ড. মো. শওকত হোসেন, অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আপডেট : ১২:১৭ এএম, শনিবার, ৪ মার্চ ২০২৩ | ৫৬৪

গ্রিক পৌরাণিক কাহিনিতে হারমিস (Hermes) নামক একটি চরিত্র আছে। দেবরাজ জিউসের কন্যা মাইয়ার (Maia) ছেলে হিসেবে তাকে দেখানো হয়েছে। কল্পকাহিনির ব্যাখ্যায় হারমিস একজন দেবতাও বটে। তবে তার ভূমিকা হলো দেবদূতের। দেবরাজ জিউসের বক্তব্য, বার্তা ও নির্দেশনা তিনি বয়ে নিয়ে আসেন মর্তলোকের মানুষের কাছে। তবে মর্তের মানুষ স্বর্গীয় বার্তা বা দৈববাণীর অর্থ ও তাৎপর্য বুঝতে সর্বদা সমর্থ হতে নাও পারে। তাই এই দৈববাণীকে শুধু আক্ষরিক বা শাব্দিকভাবেই প্রকাশ বা প্রচার করেন না হারমিস। তিনি তার অর্থ তাৎপর্য ও ভাবসহ ব্যাখ্যা প্রদান করেও স্বল্প যোগ্যতাসম্পন্ন নশ্বর মানবকুলের কাছে দৈববাণীকে বোধগম্য হওয়াতে সচেষ্ট থাকেন। এই বাণীবাহক দেবতার চেহারা খুবই আকর্ষণীয়, গতি ভীষণ ক্ষীপ্র। কেননা, তার পায়ে রয়েছে অত্যন্ত গতিশীল পাখনাযুক্ত চপ্পল, এমনকি মাথার টুপিতেও রয়েছে দুটি পাখা। হাতে আছে একটি জাদুদণ্ড (caduceus)। তিনি মানুষের চিন্তার চাইতে দ্রুতগতিতে ছুটে চলেন ও দৈববাণী প্রচার করেন।

দৈববাণী প্রচার করার কাল্পনিক কাহিনির প্রসঙ্গ আপাতত স্থগিত রাখছি। এ পর্যায়ে মর্তলোকের মানবিক বাণী আদান-প্রদান নিয়ে আলোচনা করা যাক। সসীম মানুষের সব ক্ষমতাই সীমাবদ্ধ। তবে মর্তের অন্যান্য জীবের তুলনায় মানুষের যেসব উন্নততর যোগ্যতা রয়েছে তার মধ্যে ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা শ্রেষ্ঠতম। ভাষার মাধ্যমে মানুষ একে অন্যের কাছে মনোভাবের আদান-প্রদান করে, চিন্তা ও বোধের প্রচার-প্রসার ও ভাগাভাগি করে। এটা করতে গিয়ে মানুষ কোন ঐশি সত্তা বা দেবতার সাহায্য নিচ্ছে না; বরং নিজেই হারমিস্রে ভূমিকা পালন করছে। হারমিস্ দেবতার বাণী নিজে ভালো করে বুঝতেন তার পরে মানুষের বোঝার শক্তির ওপর দৃষ্টি দিয়ে তাদের উপযোগী বা বোধগম্য করেই তা উপস্থাপন করতেন। অর্থাৎ তিনি দৈবনির্দেশ বা দৈববার্তার একটি ভাষ্য তুলে ধরতেন সসীম মানবকুলের কাছে। আমরা যখন ভাষা ব্যবহার করি, তখন আমরাও কিন্তু ভাষ্য প্রদান করে থাকি। কোনো কথা বলা মানেই ভাষ্য প্রদান করা। কেননা, ভাষ্য হলো এমন একটি ভাষিক রূপ যার মধ্যে ভাষা ব্যবহারকারীর নিজের বোধ, ব্যাখ্যা বা উদ্দেশ্য মিশে গিয়ে কোনো অর্থবোধক মনোভাব অন্যের কাছে প্রকাশিত হয়। ভাষ্যের এই ব্যাপক অর্থে আমাদের সব কথাই ভাষ্য। এমনকি আমরা যখন অন্যের কোনো কথাকে সরাসরি তার উক্তিতেও প্রকাশ করি, তখনও ভাষ্য প্রদানের বিষয় থাকতে পারে।

একেবারে একটিমাত্র শব্দ বলা লেখা বা উচ্চারণ করা থেকে শুরু করা যাক। মনে করুন, কেউ একজন ‘আগুন’ শব্দটি বলেছে। যদি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বা আনন্দিত ভঙ্গিতে বলেন তাহলে এর দ্বারা প্রসঙ্গ অনুযায়ী নানা অর্থই বোঝা যেতে পারে, যেমন কোথাও তিনি আগুন জ্বলতে দেখেছেন, কোনো কিছু জ্বালানের জন্য তার আগুন প্রয়োজন, এমনকি কারও অতি উজ্জ্বল রূপ বা অভাবনীন শৈল্পিক দক্ষতা দেখে তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে আগুন শব্দটি উচ্চারণ করা হতে পারে- ‘ছেলে তো নয় যেন আগুন’। এরকম পুরো একটি বাক্যের ভাবও আমরা ‘আগুন’ শব্দটি দ্বারা প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু এই একটি শব্দই যদি অনেক উত্তেজনা নিয়ে বারবার জোরে জোরে উচ্চারণ করা হয়- তাহলে আমরা এমন বুঝতে পারি যে, কোথাও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আগুন লেগেছে।

শুধু উচ্চারণের ঢং নয়, কথা বলার প্রসঙ্গ এবং মাত্রা, কোথা থেকে শুরু করা হচ্ছে, কোনো বিষয়টিকে বেশি আলোচনায় এনে আমরা একটি বক্তব্য প্রদান করছি- এসবের ওপরও কিন্তু ভাষ্যনির্ভর করে এবং ওই ভাষ্য থেকে আমরা কোন বিশেষ ধারণা লাভ করতে পারি। যেমন মনে করা যাক যে, কোনো একজন দার্শনিক ‘পরমাণু’ দ্বারা জগৎ সৃষ্টি হয়েছে বলে বলেছিলেন। তিনি ‘মনাদ’ (monad) শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। এর অর্থ আমরা শুধু পরমাণু করতে পারি, আবার চিৎপরমাণু, চেতন-পরমাণু, আধ্যাত্মিক পরমাণু, এমনকি দৈব-পরমাণু হিসেবেও তুলে ধরতে পারি। এর প্রত্যেকটি শব্দই আলাদা আলাদা মনোভাব প্রকাশ করতে পারে এবং বিভিন্ন ধরনের শ্রোতা বা পাঠক ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বুঝে নিতে পারেন। লিব্নিজ বা লইবনিজ (Leibniz) নামক একজন জার্মান দার্শনিক এই ‘মনাদ’ দিয়ে জগতের সৃজন প্রক্রিয়া, এমনকি, জ্ঞানতত্ত্বসহ দর্শনের নানাদিক ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি যে রচনাটিতে এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন সেই লেখাটি ছিল ফরাসি ভাষায়। আবার শব্দটির মূল উৎস গ্রিক ভাষার ‘মনাস’ (monas) শব্দ- যার অর্থ ঐক্য বা এক। পিথাগোরাস একে পরমসত্তার মর্যাদায় ব্যবহার করেছিলেন। তার কাছে এই সত্তা আধ্যাত্মিক। আর সবাই জানেন পিথাগোরাস ভাববাদী ছিলেন। কিন্তু লিবনিজের ‘মনাদ’ বলতে আমরা যদি শুধু ‘পরমাণু’ বলি, তাহলে অনেকেই হয়তো বুঝবেন যে, তিনি নির্ঘাত জড়বাদী ছিলেন।

আবার তার সঙ্গে যদি এটাও বলা হয় যে, ওই পরমাণুর সংখ্যা বহু, তাহলে তাকে বহুত্ববাদীও বলা চলে। কিন্তু এখানে এটুকুই না বলে যদি আমরা বলি যে, লিবনিজ যে পরমাণুর কথা বলেছেন তার কিন্তু চেতনা শক্তি আছে, স্বাতন্ত্র আছে। তাহলে কিন্তু এটাকে আর জড়বাদ বলে কেউ মনে করবেন না। আবার যদি বলা হয় তিনি কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ মনাদের কথাও বলেছেন- যার মাধ্যমে সব মনাদ নিয়ন্ত্রিত হয়; তাহলে কিন্তু নির্দ্বিধায় লিবনিজকে একত্ববাদী বলে যে কেউ বুঝে নিতে পারেন। এ সবই নির্ভর করছে বক্তার বলা বা ভাষ্য প্রদানের ওপর এবং শ্রোতা বা পাঠকের বোঝার যোগ্যতা বা মানসিকতার ওপর। শ্রোতা বা পাঠকের অবস্থা নিয়ে একটু কথা বলি। একবার কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এই ‘মনাদ’ নিয়ে কথা বলছিলাম। এর অর্থ তাদের কাছ থেকে জানতে চাইলে তাদের একজন বললেন এর অর্থ ‘চিৎপরমাণু’। আমি এটা কেমন তা জিজ্ঞাসা করতেই উত্তরদাতা চট করে বলে বসলেন, ‘চিৎপরমাণু হলো এমন ধরনের পরমাণু যা সবসময় চিৎ হয়ে থাকে।’ বোঝেন অবস্থা! লিবনিজের একজন অধ্যায়নকারী হিসেবে আমি সেদিন একটু ঝাকুনি খেয়েছিলাম, খোদ লিবনিজ যদি তার তত্ত্বের এই মূল শব্দটির এরকম ভাষ্য শুনতেন তাহলে তার অবস্থা না জানি কী হতো!

মানুষ নিজের অজ্ঞতা থেকে অথবা বেশি জ্ঞান থেকে কোনো বক্তব্য তুলে ধরতে গিয়ে নিজে যেমন খেই হারাতে পারেন, তেমনি শ্রোতা বা পাঠকও বিভ্রান্ত হতে পারেন, আবার কোনো পাঠ (ঃবীঃ) বা বক্তব্যের সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত অর্থ, এমনকি ভয়াবহ ক্ষতির বিষয়েও পরতে হতে পারে।

ভাষায় অনেক রূপক শব্দ, বহু অর্থবোধক শব্দ, উপমাসূচক শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে; ব্যক্তিভেদে এসব ভাষার অর্থ ও তাৎপর্য অনেকের কাছে সঠিকভাবে বোধগম্য হয় না। বিশেষ করে কবি-সাহিত্যিকরা এই ধরনের ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। তাই সর্ব-সাধারণের কাছে এর তাত্ত্বিক অর্থ পৌঁছানো অনেক ক্ষেত্রে জটিল হয়ে ওঠে, এই দিকটির প্রতি লক্ষ্য রেখে দার্শনিক প্লেটো শিশুসাহিত্যের প্রতি বিশেষ সজাগ হতে বলেছিলেন। রূপক ও দুর্বোধ্য কাহিনি শিশুদের পাঠ্য না করার বিষয়ে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন। কবি যখন বলেন, ‘প্রান্তরের সবুজ বাতাস’ অথবা ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’ তখন এই বিষয়ে শুধু শিশু নয়- কম বোধসম্পন্ন সব ব্যক্তির পক্ষে এর সঠিক পাঠ উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নারীর উদ্দেশ্যে এক কবিতায় বলেন : ‘অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা’ -তার এই উক্তিকে নিয়ে অনেক উচ্চশিক্ষিত নারীবাদীদের বলতে শুনেছি যে, রবীন্দ্রনাথ নাকি নারীকে এখানে ছোট করে দেখেছেন, তাদের পূর্ণাঙ্গ মানবসত্তার মর্যাদা দেননি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এখানে কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা অনুধাবনের জন্য আসলেই নন্দনতাত্ত্বিক জ্ঞানের বা শিল্পবোধের একটি বিশেষ স্তর পাঠককে পার করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিজ্ঞজনরা নিঃসন্দেহে তা বুঝতে পারেন।

এবার একটু বৈষয়িক ও সমাজ-রাজনৈতিক সাধারণ বক্তব্যের বিষয়ে আসা যাক। একটি উন্নয়নশীল বা উদীয়মান অর্থনীতির দেশে হঠাৎ করে বড় বড় স্থাপনা নির্মাণসহ বস্তুগত উন্নয়নের বিশাল সব প্রকল্প দেখে কেউ কেউ বেশ আশাবাদী হয়ে বলতে পারেন যে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আমাদের অগ্রগতি হচ্ছে। আবার কোনো কোনো ব্যক্তি এমন বলতে পারেন যে, দেশে বড় রকমের দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করা হয়েছে, বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়ছে, দেশ দেউলিয়া হবার আশঙ্কা আছে। একই বিষয় নিয়ে এই বিপরীতধর্মী ব্যাখ্যা মূলত এক একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিজাত মতামত (interpretation)-এর মধ্যে কোন্টি সত্য তা আমজনতার কাছে তৎক্ষণাৎ বুঝে ওঠার কোনো উপায় সাধারণত থাকে না। ধর্মতাত্ত্বিক ও নীতিতাত্ত্বিক বিষয়েও তেমনটি হয়ে থাকে। ধর্মকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে অনেকেই সচেষ্ট। কিন্তু তাদের ব্যাখ্যায়ও বৈপরীত্য দেখা যায়।

জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়ের সমাধানে বক্তার দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে তারতম্যের জন্য সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মের নামে নানান অধর্মও প্রচারিত হয়। কেউ কেউ ধর্মীয় মূলনীতি ও বিশেষ প্রসঙ্গের নির্দেশনাকে খণ্ডিত ও ভ্রান্তভাবে উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহার করে নানা রকম বিভ্রান্তি বিভেদ তৈরি করে থাকেন। নৈতিক নীতির তাত্ত্বিক বহুত্ব সাধারণ মানুষকে বিব্রত করে। এ সবই ঘটে থাকে মূলত ভাষ্য প্রদানের ব্যর্থতাকে কেন্দ্র করেই। ধর্মতত্ত্বসহ দর্শন, সাহিত্য ইত্যাদির ব্যাখ্যা সংক্রান্ত বিষয়ে সজাগ হতে মধ্যযুগে হারমেনিউটিক্স (Hermeneutics) বা ভাষ্যবিদ্যা নামক একটি বিদ্যা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। অধুনা দার্শনিক শ্লায়ারমাকার, হাইডেগার, গাদামার প্রমুখ-এর চর্চাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। অবশ্য সেই প্রাচীন যুগে দার্শনিক প্লেটোই ভাষ্যবিদ্যা আলোচনা শুরু করেছিলেন। তিনি মূলত তৎকালীন সোফিস্ট (sophist) নামে পরিচিত জ্ঞান নিয়ে বাণিজ্য করে বেড়ানো একদল দার্শনিকের বিরুদ্ধে ভাষ্যবিষয়ক নানা প্রশ্ন তুলেছিলেন। বিশেষ করে সোফিস্টরা রাজনীতির অঙ্গনে ব্যবহার করার জন্য যে ধরনের বাক্কলা বা রিটোরিকের শিক্ষা দিতেন তৎকালীন তরুণ সমাজকে- সেই শিক্ষার নৈতিক ও যৌক্তিক দিক নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন। তবে ওই সময় ভাষ্যবিদ্যা বা হারমেনিউটিক্স নাম দিয়ে বিদ্যাটি চর্চিত হয়নি।

মধ্যযুগ থেকে শুরু করে সমকাল পর্যন্ত ভাষার ব্যবহার সংক্রান্ত ব্যাপক দার্শনিক জটিলতা চিন্তাশীলদের নজরে আসে। ধর্ম, রাজনীতি, ব্যবসায় ইত্যাদি প্রায়োগিক বিষয়সহ মানবিক বিদ্যার বিভিন্ন দিকের তাত্ত্বিক আলোচনায়ও ভাষ্যবিষয়ক জটিলতা প্রকট হয়ে উঠেছে। ভাষ্য-ভেদে ভাষা অনেকভাবে ভ্রান্ত অর্থ প্রদান করছে।

এই ব্যর্থতা উদ্দেশ্যমূলক না হলে তা ক্ষমাযোগ্য। কিন্তু অনেকে আবার বিশেষ উদ্দশ্যে বা বলা যায় অসৎ স্বার্থপূর্ণ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ইচ্ছা করেই সাধারণ একটি বাস্তব ঘটনা থেকে শুরু করে শিল্প-সাহিত্য-দর্শন, এমনকি ধর্মেরও ভুল ব্যাখ্যাকে প্রচার করে বেড়ান। এ ধরনের মানুষের জন্য প্রকৃত সত্য সর্বসাধারণের কাছে অনেক ক্ষেত্রেই অধরা থেকে যায়। এদের উদ্দেশ্যে শোপেনহাওয়ার বলেছিলেন, তারা মেটাফিজিকাল বা অধিবিদ্যক জীব। যারা স্বার্থের কারণে সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে মানুষকে বোঝাতে বা ভোলাতে চেষ্টা করে, আবার উদ্দেশ্যমূলক ভাষ্য প্রদান করে অনেকেই চৌর্ষবিদ্যা, প্রতারণা ইত্যাদি করে বৈষয়িক সফলতা অর্জনের অশুভ প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে আছে। এদের গুরুও বোধকরি সেই কল্পকাহির হারমিস্। কেননা, হারমিস যে শুধু দেবদূত বা দৈববাণী প্রচারের জন্য ভাষ্যগুরু বলে পরিচিত তা-ই নয়, গ্রিক কল্পকাহিনীতেই তাকে আবার ব্যবসা-বাণিজ্য, ফটকাবাজী, ভবঘুরেপনা, এমনকি চৌর্যবৃত্তির গুরু হিসেবেও দেখানো হয়েছে। মনে রাখা দরকার যে, গ্রিক মীথের চরিত্রগুলো প্রতীকীভাবে মানব সমাজের নানা রংগের চরিত্রের রূপ বহন করে। ভাষার ভাষ্যকে অপব্যবহার দ্বারা বহুবিধ অপকর্ম করে তথাকথিত সাফল্য অর্জন করাও সম্ভব। আর এর ফলে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হতে পারেন সর্বস্তরের মানুষ। ভাষ্যবিদ্যার চর্চা আজকের দিনে তাই জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে।

ভাষ্য ও ভাষ্যবিদ্যা নিয়ে এতক্ষণ হয়তো অনেক ভারি বক্তব্য ব্যক্ত করে ফেলেছি। এখন একটু হালকা কথা বলা যাক। একটি গল্প বলব। আমরা আগেই বেলেছি, আমরা যখন ভাষা ব্যবহার করি, তখন পরিস্থিতি ব্যক্তি ও বক্তব্যের ধরনের ভিত্তিতে তা বিশেষ বিশেষ ভাষ্য প্রদান করে। বর্তমান গল্পটি এ ব্যাপারটিকে কেন্দ্র করেই। গল্পের নায়ক একজন উদীয়মান কবি। তিনি নতুন বিয়ে করেছেন, মাত্র দু’দিন হলো। তার স্ত্রী খুবই শ্রীমতী, তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পর্যন্ত তার পড়ালেখা। খুবই সরল-স্বভাবের তথাকথিত আদর্শ রমণী। যাহোক, বিয়ের তৃতীয় দিনে এ তরুণ কবি তার সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে কোনো পূর্ণিমা রাতে তাদের বাড়ির কাছে একটি ছোট নদীর তীরে বসে জ্যোৎস্না দেখছেন। এক পর্যায়ে কবি বেশ রোমান্টিক হয়ে ওই সরলা-সুন্দরী বধুর হাত ধরে বলে চলছেন: ‘... আজ থেকে তুমিই আমার কবিতা, তুমিই আমার কল্পনা এবং তুমিই আমার সাধনা।’ এই আবেগি কথায় আপ্লুত হয়ে সরল স্ত্রী সবেগে বলে বসলেন : ‘... হ্যাঁ, আমিও ভেবেছি, আজ থেকে তুমিই আমার আকাশ, তুমিই আমার সমীরণ এবং তুমিই আমার আজমল ভাই।’

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত