এক মাসে ১২২ কেজি মাংস,জবাইকৃত হরিন,চামড়া মাথা ও ফাঁদ উদ্দার

বন্ধ হচ্ছেনা সুন্দরবনে হরিণ শিকার

মাসুদ রানা,মোংলা

আপডেট : ০৭:১৩ পিএম, শুক্রবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০১৯ | ১৮৭২

সুন্দরবনের অভ্যন্তরে শীত মৌসুমে সংঘবদ্ধ হরিণ শিকারী চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। নাইলনের ফাঁদ, জাল পেতে, স্প্রীং বসানো ফাঁদ, বিষটোপ, গুলি ছুঁড়ে, কলার মধ্যে বর্শি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা ফাঁদসহ পাতার ওপর চেতনানাশক ঔষুধ দিয়ে হরিণ শিকারিরা হরিণ শিকার করে তা মোংলাসহ দেশের ভিন্ন স্থানে চড়া দামে বিক্রী করা হচ্ছে। বন বিভাগ, কোষ্টগার্ড ও অন্যান্য আইন শৃংখলা বাহিনীর কঠোর নজরদারীর মধ্যেও চোরা শিকারীরা কৌশলে সুন্দরবন থেকে হরিণ শিকার করছে।


গত প্রায় দু’সপ্তাহের ব্যবধানে বন বিভাগ ও কোষ্টগার্ড পৃথক চারটি অভিযান চালিয়ে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা থেকে শিকার করে আনা জবাইকৃত হরিন,৬৩ কেজি হরিণের মাংস, মাথা, চামড়াসহ শিকারীদের ব্যবহত হরিণ শিকারের সরঞ্জামাদি উদ্ধার করেছে। এর আগে গত ২১ থেকে ২৩ নভেম্বর রাস মেলা চলাকালীন সময়ে বন বিভাগ ও আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে হরিণের মাংস, হরিণ ধরার ফাঁদ, সরঞ্জাম ও নৌকাসহ ৫৭ জনকে আটক করে।


আটককৃতদের বন আইনে মামলাও দেওয়া হয়। এ সময় হরিণের মাথা, চামড়াসহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছে বনবিভাগের সদস্যরা। এ ছাড়া ২২ জনকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। সর্ব শেষ ৩০ জানুয়ারী গভীররাতে চড়াপুটিয়া থেকে ৩৫ কেজি ওজনের একটি জবাইকৃত হরিন ও ফাদঁ উদ্ধার করা হয়। রাস মেলা ও বর্তমান সময়ে ব্যাপকভাবে হরিণ শিকারের ঘটনায় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো উদ্বেগ জানিয়ে এ জন্য প্রশাসন ও বনবিভাগকে আরো কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জয়মনি ও সুন্দরবন ইউনিয়নের একাধিক বনজীবী বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, রাস মেলায় ব্যাপকহারে হরিণ শিকার হয়েছে সেতুলনায় এখন তার পরিমান কম। তবে একেবারে বন্ধ হয়নি। বিভিন্নভাবে চোরা শিকারীরা হরিণ শিকার করে লোকালয়ে তা বিক্রী করছে। নাইলনের ফাঁদ, জাল পেতে, স্প্রীং বসানো ফাঁদ, বিষটোপ, গুলি ছুঁড়ে, কলার মধ্যে বর্শি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা ফাঁদসহ পাতার ওপর চেতনানাশক ঔষুধ দিয়ে হরিণ শিকারিরা বিপুল সংখ্যক হরিণ শিকার করে থাকে চোরা শিকারীরা। এরপর চামড়া, শিং সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ পাঠিয়ে দেওয়া হয় উপযুক্ত ক্রেতাদের কাছে। কখনো কখনো ঝামেলা এড়াতে তা মাটিতে পুঁতে বা সাগরে ফেলে দেওয়া হয়। আর মাংস ‘রাজ মাংস’ নামে মোংলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭শ’ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত কেজি প্রতি স্থানভেদে বিক্রি করা হয়। ৩০ জানুয়ারী রাতে মরাপশুরের কাগাখালে ভাড়ানী দিয়ে চড়াপুটিয়ার অফিস ইনচার্জ মোঃ ইসমাইল হোসেন বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান,টহলরত অবস্থায় একটি নৌকা, তার একটু উপরে ৩৫ কেজি ওজনের একটি জবাইকৃত হরিন ও ২০০ হাত ফাদঁ উদ্দার করা হয়। এসময় নৌকায় থাকা চাদঁপাই ষ্টেশন থেকে ১৫ জানুয়ারী মোংলা উপজেলার দঃ চাদঁপাই ইউনিয়নের হাকিম হাওলাদার’র ছেলে একলাস (৩৫),ইলিয়াস (৩২) ও ইয়াসীন হাওলাদার (২৯) নামে একটি মাছের পাশ উদ্ধার করে। তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা। এছাড়া গত ১৯ জানুয়ারি দিনগত রাতে সুন্দরবন থেকে আট কেজি হরিণের মাংসসহ একটি চামড়া ও একটি মাথা উদ্ধার করেছে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন। মোংলা উপজেলার আমবাড়িয়া খাল সংলগ্ন এলাকা থেকে এগুলো উদ্ধার করা হয়।


বাংলাদেশ কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের গোয়েন্দা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট আব্দুল্লাহ আল-মাহমুদ বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শনিবার দিনগত রাতে অভিযান চালিয়ে হরিণের মাথা, মাংস ও চামড়া উদ্ধার করা হয়। এসময় পাচারকারীরা পালিয়ে যাওয়ায় তাদের আটক করা যায়নি। পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নিতে উদ্ধার হওয়া হরিণের মাথা, মাংস ও চামড়া জোংরা ফরেস্ট অফিসে হস্তান্তর করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। এর আগে ১৭ জানুয়ারী পশ্চিম সুন্দরবনের সাতীরা রেঞ্চের তেরকাটি খাল এলাকা থেকে এলাকা থেকে ২৫ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করেছে বন বিভাগ। এ ছাড়া ৭ জানুয়ারী বনবিভাগ মোংলার পশুর নদীর চিলা বাজার সংলগ্ন কানাইনগর এলাকা থেকে একটি ডিঙ্গি নৌকাসহ ৩০ কেজি হরিনের মাংস উদ্ধার করে। অবশ্য এসব ঘটনায় কাউকে আটক করতে পারেনি বন বিভাগরে উদ্ধারকারী বনরক্ষিরা।


রাস মেলা ও পরবর্তী সময়ে বিপুল সংখ্যক হরিণ শিকারের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন। সুন্দরবন নিয়ে গবেষনাকারী বেসরকারী সংগঠন ‘সেভ দ্যা সুন্দরবনের’র চেয়ারম্যান ফরিদুল ইসলাম বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, বন বিভাগ ও প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় এবার রাস মেলায় অনেক বেশী হরিণ নিধনের ঘটনা ঘটেছে। এখন একটু কমলেও হরিণ শিকার চলছে। বন বিভাগ ও প্রশাসনকে হরিণ শিকার রোধে আরো বেশী কঠোর হতে হবে। হরিণ শিকার রোধে দৃশ্যত বাইরে থেকে বনবিভাগ কঠোর নজরদারি করছে মনে হলেও হরিণ শিকার কিন্তÍ বন্ধ হয়নি। বন আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি বনসংলগ্ন লোকালয়গুলোতে বিভিন্ন সচেতনতামুলক প্রচারের ও আহ্বান জানান তিনি।


পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মাহমুদুল হাসান বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, নানা সীমাবদ্ধতা ও লোকবলসংকটের মধ্যেও হরিণ শিকারিদের অপতৎপরতা রোধ করতে বনবিভাগ সবসময় তৎপর রয়েছে। বনরক্ষীদের পাশাপাশী আমাদের স্মার্ট পেট্রোল দল সবসময় কাজ করছে। যাদেরকে আমরা আটক করে আদালতে প্রেরণ করি তার ফাকফোকর দিয়ে বের হয়ে যায় তবে তাদেরকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন। তাহলে এই জাতীয় অপরাধ সংঘটনের হার বহুলাংশে হ্রাস পাবে। এছাড়া আমরা বিভিন্নভাবে সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়গুলোতে সচেতনতামূলক কর্মকান্ড গ্রহন করছি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত