চিতলমারীতে এনজিও ও সমিতির মহাজনদের কবলে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ

স্টাফ রির্পোটার

আপডেট : ০৬:২২ পিএম, বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারী ২০২০ | ৭৬৮

কুয়াশাচ্ছন্ন চারিদিক। হাঁড় কাঁপানো শীত। ভোর ৫ টায় বের হয়েছে ওয়াহিদুল। অটোরিক্সার গ্লাসটা মুছতে হচ্ছে বারবার। বাসা থেকে বের হতে মন চাচ্ছিল না। উপায় নেই। প্রতিদিন মোটা অংকের কিস্তি’র টাকা। চাল-নুন কেনা হোক বা না হোক, কিস্তি দিতে হয় নিয়মিত। তা-না হলে যেতে হবে জেলে। এমনাই জানাচ্ছিলেন মোঃ ওয়াহিদুল মুন্সি (৩৮)।

তিনি আরও জানান, বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার খড়মখালী গ্রামের মৃত আব্দুর রব মুন্সির ছেলে সে। স্ত্রী ও ৩ মেয়ে নিয়ে ৫ সদস্যর পরিবার তার। উপজেলা সদর বাজারে স্বাধীন কস্মেটিক্স নামে বিশাল একটি দোকান ছিল। এই দোকান পরিচালনা করতে তিনি চিতলমারী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি থেকে ৫ লাখ, অন্য একটি সমবায় সমিতি থেকে ২ লাখ, এনজিও এসডিও থেকে ৩ লাখ ও গনমিলন থেকে ২ লাখ, মোট ১২ লাখ টাকা ঋণ গ্রহন করেন। আর এরপর থেকেই ধীরে ধীরে তার সুখের ঘরে দুঃখের আগুন প্রবেশ করে। দোকানপাট, মালপত্র ও ফার্নিসার সব কিছু বিক্রি করে দেনা পরিশোধ হয়নি সমিতি ও এনজিও মালিকদের। এখনও দেনা ৭ লাখ টাকা। তাই দেনা পরিশোধে তিনি এখন ভাড়ায় চালিত অটোরিক্সার ড্রাইভার।

বাস্তহারা আজিজ কাজী (৪০)। ছোট বেলা থেকেই চিতলমারী বাজারের সওদাগর পট্টিতে মনোহারী ব্যবসা করেন। ব্যবসার জন্য লোন নিয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি থেকে ১১ লাখ, অন্য একটি সমবায় সমিতি থেকে ৫ লাখ, সূর্যতরুণ থেকে ১ লাখ ও রংধনু থেকে ৩ লাখ টাকা। দৈনিক তার প্রায় ১০-১২ টাকা কিস্তি ও সঞ্চয়। তাই সমবায় সমিতি গুলোর রাহুগ্রাস থেকে বাঁচতে দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। সুযোগ পেয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে চিতলমারী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লোনের বিপরীতে আজিজের কাছ থেকে তার বহুকষ্টে ক্রয়কৃত (খড়মখালী মৌজা, বিআরএস খতিয়ান নং-৬৮২, দাগ নং-১৮৫) ৭শতক জমি রেজিষ্ট্রি করে লিখে নেন। এরপরও আজিজ ঋণমুক্ত হননি। হয়েছেন বাস্তহারা। এখনও তার প্রতিদিন কিস্তি দিতে হয় ৫ হাজার ২৫০ টাকা ও সঞ্চয় ২০০ টাকা।

মোঃ রফিকুল ইসলাম (৪১)। রেক্সিন ও স্কুল ব্যাগের ব্যবসা করেন সদর বাজারে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি থেকে ১১ লাখ-দৈনিক কিস্তি সাড়ে ৫ হাজার, এসডিও থেকে ২ লাখ-দৈনিক কিস্তি ৮৫০, রংধনু থেকে ২ লাখ-দৈনিক কিস্তি ১ হাজার, সূর্যতরুণ থেকে ১ লাখ-দৈনিক ৬০০ টাকা, গনমিলন থেকে ১ লাখ-দৈনিক কিস্তি ২ হ্জাার ৬০০, লাইফ লাইন থেকে ১ লাখ-সপ্তাহে ২ হাজার ৬০০, বিআরডিবির ৩ লাখ-মাসে কিস্তি ৩০ হাজার টাকা কিস্তি। এছাড়াও রয়েছে পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফাউন্ডেশনের কিস্তি ও বিভিন্ন সমবায় সমিতি ও এনজিও’র সঞ্চয়ের টাকা। রফিকুলের সারাদিনে বিক্রি হয় পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা। তাই তার পরিবারে বর্তমানে দিন চলে খেয়ে না খেয়ে।

মরিরুল ইসলাম খাকী (৩৫)। চিতলমারী বাজারের সওদাগর পট্টিতে ব্যবসা করতেন বড় সু নামের সাথে। তার প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল আল্লাহর দান স্টোর। ব্যবসার পরিধি বাড়াতে লোন নেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতিসহ বিভিন্ন সমিতি ও এনজিও থেকে। জড়িয়ে পড়েন লোভী মাকড়সার জালে। এখন মনিরুল দেনার দায়ে দোকানপাট লিখে দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

শুধু ওয়াহিদুল, আজিজ, রফিকুল আর মনিরুল নয় বিভিন্ন সমবায় সমিতি ও এনজিও’র ঋণ গ্রহন করে চিতলমারীর কয়েকশ’ ব্যবসায়ী এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। দেনার দায়ে জর্জারিত এসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা এখন মানবেতর জীবন যাবন করছেন। অনেই মানষিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন।

ঋণগ্রস্থ ব্যাবসায়ীরা জানান, একজন ব্যাক্তিকে লোন নিতে হলে শতকরা ১০ ভাগ সঞ্চয়, বীমা ২ ভাগ (অফেরৎ যোগ্য), অফিস খরচ ১০ ভাগ (অফেরৎ যোগ্য) ও মোটা অংকের টাকা শেয়ার জমা রাখতে হয়। তাতেই চলে যায় গ্রহনকৃত লোনের এক চতুর্থাশং। বাকি টাকা দিয়ে দৈনিক কিস্তি হিসেবে ২-৩ মাসের মধ্যে দোকানের পুরো টাকাই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু বকেয়া থেকে যায় ঋণের টাকা। বিপাকে পড়ে ব্যবসায়ীরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, চিতলমারী উপজেলায় ৫ টি ব্যাংক, ১৫-২০ টি এনজিও ও ১০৩টি সমবায় সমিতি রয়েছে। এরমধ্যে এনজিও ও সমবায় সমিতির লোন সহজ শর্তে পাওয়ায় ক্ষুদ্র এবং মাঝারী ব্যবসায়ীরা জড়িয়ে পড়ছে ঋনের জালে। অনেক সমিতি নামে মাত্র সমিতি হলেও চালাচ্ছে ব্যাক্তি মালিকেরা। কয়েকটি সমিতির বিরুদ্ধে এফডিয়ার গ্রহনেরও অভিযোগ উঠেছে।

চিতলমারী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি’র সভাপতি মৃম্ময় বালা জানান, ঋণ দিয়ে বাধ্য করে আজিজের জমি ক্রয় করা হয়নি। সে সদিচ্ছায় ওই জমি তাদের কাছে বিক্রি করেছে।

এছাড়া অধিকাংশ সময়ায় সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে চিতলমারী উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মোল্লা সাইফুল ইসলাম জানান, এফডিয়ার এবং বীমা গ্রহণের কোন বৈধতা সমবায় সমিতি গুলোর নেই। এক ব্যাক্তি একাধিক সমিতির সদস্য হয়ে ঋণ গ্রহন করতে পারেন। কিস্তি দৈনিক হবে না, সাপ্তাহিক হবে এটা নির্ভর করে সমিতির কার্যকরী কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত