একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছোট ভাইর বয়স ৩৭ আর ৪ ভাই বোনের মধ্যে বড় বোনের বয়স ৩৪ বছর

জাল সার্টিফিকেটে চাকরি: ১২ দপ্তরে অভিযোগ

মাসুদ রানা

আপডেট : ১১:১৮ পিএম, রোববার, ৬ মার্চ ২০২২ | ৮৮৪

প্রতারনা ও জাল সার্টিফিকেট তৈরী করে মাদ্রাসার চাকরি নিয়েছে ৪২ বছর বয়সী নাজমা বেগম নামের এক নারী বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে । তিনি প্রথমে ১৯৯৬ সালে স্কুল থেকে এস এস সি পরিক্ষা দিয়েও পুনরায় অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধনে মায়ের নাম পরিবর্তন আইডি ও সার্টিফিকেটসহ অন্যান্য জাল কাগজ পত্র তৈরী করে জিউধারা এম বাজার দাখিল মাদ্রাসায় কর্মচারী পদে চাকরী করছে। ছোট ভাইর বয়স ৩৭ আর ৪ ভাই বোনের বড় বোন, বয়স ৩৪ বছর দেখিয়ে কাগজ পত্র জমা দিয়েছে। তার সকল ভাই বোনের মধ্যে ৪র্থ তম ছোট ভাই ৩৭ বছর বয়সী মফিজুর রহমান একই প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত রয়েছে কিন্ত সরকারের দেয়া নিয়ম মানছেন না। এ ঘটনায় ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরীর প্রার্থী সোনিয়া ও শিল্পি আক্তার শিক্ষা মন্ত্রনালয়সহ সংশ্লিষ্ট ১২টি দপ্তরে অভিযোগ দিয়েছে। প্রতারনা মুলক এ নিয়োগ নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।


বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জিউধারা এম বাজার নেছারিয়া দাখিল মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ দুই জন চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হবে মর্মে জনবল কাঠামো ২০১৮’র অনুযায়ী গত ২০২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর দৈনিক পুর্বাঞ্চল পত্রিকায় দ্বিতীয় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সার্কুলার দেয়া হয়। সেই মোতাবেক দুইটি পদের অনুকুলে প্রায় ১৩ জন প্রার্থী অংশ গ্রহন করে। এর মধ্যে চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী (মহিলা) পদেই মোসাঃ সোনিয়া, শিল্পি, মেরী, দুলী, আদুরী, নাজমা ও (রুমা আক্তার অনার্স অধ্যায়নরত, মাদ্রাসার অফিস সহকারী মফিজুর রহমান’র স্ত্রী) সহ ৭জন অংশ গ্রহন করে। দীর্ঘ ৪ মাস পর গত ১৫ জানুয়ারী ওই প্রষ্ঠিানে বসে নিয়োগ পরিক্ষা না নিয়ে কাগজ পত্র যাচাই-বাছাই ছাড়াই অন্য উপজেলা রামপালের ফয়লারহাট আছিয়া কারামাতিয়া মাদ্রাসায় বসে গোপনে নিয়োগ পরিক্ষা নেয়া হয়। নিয়োগ বোর্ডে ডিজি প্রতিনিধির প্রধান ঢাকা মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিদর্শক মোঃ হেলাল উদ্দিন, উপজেলা শিক্ষা অফিসার আঃ হান্নান, মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মোঃ গফ্ফার হাওলাদার, যাচাই-বাছাই কমিটির প্রধান এম বাজার দাখিল মাদ্রাসার সুপার মাওঃ মোঃ ইয়াকুব আলী, সদস্য আলহাজ্ব মাস্টার নুর ইসলাম মৃধাসহ ৫ সদস্য বিশিষ্ট নিয়োগ বোর্ড’র প্রতিনিধিরা উপস্থিত থেকে ওই দুই জনকে মাদ্রাসায় নিয়োগ প্রদান করেন। সেখানে নিয়োগ প্রাপ্ত মাদ্রাসার কর্মচারী নাজমা বেগম’র সার্টিফিকেটে তার জন্ম তারিখ ১৯৮৭ সালের ১ জানুয়ারী উল্লেখ করেছে। আর মায়ের নাম পরিবর্তন করে সাহিদা বেগমের স্থলে দেয়া হয়েছে মোসাঃ নুরজাহান বেগম।

এদিকে, উক্ত নাজমা বেগম ১৯৯৬ সালে জিউধারা ¯্রজেন স্মৃতি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এস এস সি পরিক্ষায় অংশ গ্রহন করে। যেখানে তার রোল নং-৫৫১০৫৭, রেজিঃ নং-০৮০৯৬০ এবং শিক্ষা বর্ষ ১৯৯৪-৯৫ সাল। সেখানে তার জন্ম তারিখ ১০ ডিসেম্বর ১৯৮১ সাল দেখানো হয়েছে এবং বাবার নাম জয়নাল আবদীন ও মায়ের নাম দেয়া হয়েছে সাহিদা বেগম। যা অন্যান্য ভাই বোনের মায়ের নামের সাথে মিল রয়েছে।

এছাড়াও, জাতীয় পরিচয় পত্র অনুয়ায়ী বাবার ৬ষ্ঠ সন্তান (তাঁর ছোট ভাই) মোঃ মিরাজুল ইসলাম’র জন্ম ১৯৮৭ সালের ১০ অক্টোবর দেখানো হয়, যা ২য় সন্তান ও ৬ষ্ঠ সন্তান একই সালে জন্ম গ্রহন করেছে বলে সরকারী কাগজ পত্রে প্রতিয়মান যা সোনিয়া ও শিল্পি আক্তার তাদের অভিযোগে উল্লেখ করে। তাই নিয়োগ প্রাপ্ত নাজমা বেগমের জন্ম সনদ, জাতীয় পরিচয় পত্র, স্কুল সার্টিফিকেট ও মায়ের নাম সাহিদা বেগম’র পরিবর্তে নুরজাহান বেগম দিয়ে জাল-জালিয়াতীর মাধ্যমে কাগজ পত্র সংগ্রহ করে মাদ্রাসায় চাকুরী দিয়েছে অসাধু নিয়োগ বোর্ড বলে অভিযোগকারীরা দাবি করে।

অভিযোগকারী সোনিয়া বলেন, সকল তথ্য উপাত্ত গোপন রেখে মাদ্রাসার সুপার মাওঃ ইয়াকুব আলী ও সহ-সুপার গাজী নুরুজ্জামানের মাধ্যস্থতায় মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময় জালিয়াতীর মাধ্যমে ৪২ বছর বয়সী নাজমা বেগমকে ৩৪ বছর ১৫ দিন বয়স দেখিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়। কালক্ষেপন না করে নিয়োগ পরিক্ষার পরের দিনই দ্রুত নাজমা বেগমকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদান করার জন্য অনুমতি পত্র প্রদান করেন অফিস সহকারী ও মাদ্রাসার সুপার। কিন্ত তার ভাই ওই মাদ্রাসায় অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত রয়েছে জেনেও ৪২ বছর বয়সী বড় বোনকে ৩৪ বছর বয়স দেখিয়ে প্রতারনা করে প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী পদে নিয়োগ দেয় সুপার।

সরকারী চাকুরীর বয়সসীমা ১৮ থেকে ৩৫ বছর নিয়োমানুযায়ী যোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ না দিয়ে উৎকোচের বিনিময় ওই মাদ্রাসায় মহিলা কর্মচারীর কাগজ পত্র জাল-জালিয়াতী ও নিরাপত্তাকর্মী পুরুষ হিসেবেও যাকে নিয়োগ দিয়েছে মাদকসহ তার বিরুদ্ধেও রয়েছে বহু অভিযোগ যা আবেদনে উল্লেখ করে।


মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি, বর্তমান কমিটির সদস্য লিটন মৃধা, রুহুল আমিন সরদারসহ স্থানীয়রা জানায়, এ মাদ্রাসাটি জড়াজির্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ৩শতাধিক ছাত্র/ছাত্রীদের লেখা-পড়ার জন্য বসারমতো তেমন ব্যাবস্থা নাই। মাদ্রাসার সুপার যেমনটি ইচ্ছা তেমনটি করে যাচ্ছে, সরকারের নিদের্শনাও তোয়াক্কা করছেনা তিনি। বর্তমানেও নিয়োগে ব্যাপক দুর্নিতী করেছে যা সর্ব মহলে গুঞ্জন চলছে, যার সুষ্ঠ প্রতিকার চান এলাকার প্রবীন নেতৃবৃন্দরা অনেকেই।


তবে অভিযুক্ত নাজমা বেগমের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ভাই মফিজুরের কৌশলগত কারনে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।


মাদ্রাসার সুপার মাও. মোঃ ইয়াকুব আলী বলেন, এই মাদ্রাসায় নাজমা বেগমের ছোট ভাই মফিজুর রহমান অফিস সহকারী হিসেবে চাকরী করছে এটা সত্য কিন্ত আমি এ প্রতিষ্ঠানে সুপারেন্টেডেন্ট হিসেবে আমি নতুন তাই নিয়োগ বোর্ডে দেয়া কাগজ পত্র অনুযায়ী নিয়োগ দিয়েছি। তবে নাজমা বেগমের কাগজ পত্রে জালিয়াতির আশ্রয় নিলে চাকরীচ্যুতসহ কঠোর ব্যাবস্থা নেয়া হবে।


উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ আঃ হান্নান জানান, সম্প্রতি এম বাজার দাখিল মাদ্রাসায় দুই জন কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে নাজমা বেগম’র বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট, বয়স, মায়ের নাম ও অন্যান্য কাগজ পত্র জাল করা হয়েছে বলে একটি লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে কিছুটা সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানে ৩৭ বছর বয়সী তার ছোট ভাই অফিস সহকারী হিসেবে চাকরী করছে এটা আমাদের জানা ছিলনা, নিয়োগের সময় বিষয়টি অবগত হলে নিয়োগ স্থাগিত রাখা হতো। সোনিয়ার দেয়া অভিযোগের ব্যাপারে গুরুত্ব নিয়ে তদন্ত চলছে, অভিযোগের সত্যতা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেয়া হবে।


জেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, শিল্পি ও সোনিয়া আক্তার নামের দু’জন চাকুরী প্রাথী আমি সহ মন্ত্রনালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেছে যা অবগত হয়েছি। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবগত করানো হয়েছে এবং অভিযুক্ত নাজমা বেগমকে এখনই বেতন ভাতাদির আওতায় না নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। এছাড়াও তার কাগজ পত্র যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তদন্ত চলছে, জালিয়াতী বা প্রতারনার আশ্রয় নিলে অবশ্যই সরকারী বিধি অনুযায়ী ব্যাবস্থা নেয়া হবে।


নিয়োগ বোর্ডের ডিজির প্রতিনিধি মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিদর্শক মোঃ হেলাল উদ্দিন বলেন, যাচাই-বাছাই কমিটির প্রধান মাদ্রাসার সুপারসহ নিয়োগ বোর্ডের অন্যান্য সদস্যরা সবাই কাগজ পত্র পর্যালোচনা করে একমত হওয়ার পরিপেক্ষিতে নাজমা বেগমকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সার্টিফিকেট জালিয়াতির ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না, তবে প্রমানিত হলে তার ভাইসহ তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহন করা হবে বলেও জানান ডিজির এ প্রতিনিধি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত