নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোটাররা থাকেন দুশ্চিন্তায়

শেখ আহসানুল করিম

আপডেট : ০৬:১৮ পিএম, শুক্রবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮ | ৬৭২

বাগেরহাট সদর উপজেলার ষাটগম্বুজ ইউনিয়নের পশ্চিম সায়েড়া গ্রামের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বিকাশ চন্দ্র পাল আওয়ামী লীগের ঘোর সমর্থক ছিলেন। ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নৌকার পে স্বক্রিয় ভাবে কাজ করেছিলেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পরদিন ২ অক্টোবর তৎকালিন চারদলীয় ঐক্যজোটের সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্য দিবালোকে তাকে তার বাড়ির সামনে রাস্তায় ফেলে বেদম মারপিট করে আহত করে। ওই সময়ে বাগেরহাট শহরের একটি বেসরকারি কিনিকে দুই সপ্তাহ চিকিৎসা শেষে বিকাশ পার্শ্ববর্তি দেশ ভারতে পালিয়ে যায়। ওই যুবক আর কোনদিন দেশে ফেরেনি। আবার ভোট এসেছে। পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে তাই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন বিকাশের বৃদ্ধ বাবা অধীর কুমার পাল (৭৭)। তিনি বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, জাতীয় ‘সংসদ নির্বাচনের কথা মনে পড়লে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। আমার বড় ছেলে ২০০১ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের পক্ষে কাজ করায় বিএনপি দলীয় সন্ত্রাসীরা দিনের বেলায় সবার সামনে বাড়ির সামনে রাস্তার উপর ফেলে তাকে লাঠিসোটা দিয়ে বেদম প্রহার করে। আমরা সেদিন কিছুই করতে পারিনি। বরং প্রাণ নাশের ভয়ে তাকে ভারতে পাঠিয়ে দেই। এরপর সে আর কোনদিন দেশে ফেরেনি। এবার আবার কি হয় জানিনা ’।

একই রকম ঘটনা ঘটেছিল সায়েড়া মধুদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রয়াত তৎকালিন সহকারী শিক জগদীশ চন্দ্র মন্ডলের পরিবারে। নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার অপরাধে তার বড় ছেলে বিপ্লব কুমার মন্ডলকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। ভারত থেকে বিপ্লব আর কোনদিন দেশে ফেরেননি। জগদীশ মন্ডল নির্বাচনের পর ১৮ মাস ভারতে আত্মগোপণ করে দেশে ফেরেন। এরপর কয়েক বছর পর তিনি রোগে ভুগে মারা যান। বিএনপি দলীয় সন্ত্রাসীরা জগদীশ মন্ডলের ছোট ছেলে পল্বব মন্ডলকে বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজে যাওয়ার পথে মারধর করে তার সাইকেলটি ছিনিয়ে নিয়েছিল। ওই পল্বব তখন বাগেরহাট সরকারী পিসি কলেজের ছাত্র ছিলেন। বর্তমানে তিনি রামপাল উপজেলার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন।

পশ্চিম সায়েড়া গ্রামের পল্বব মন্ডল এই শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট বলেন, ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হওয়ার কয়েকদিন পর বিএনপি সমর্থকরা আমার বাবার সাবেক ছাত্ররা আমার বাবা ও বড় ভাইকে খুঁজতে বাড়িতে আসেন। এরপর ভয়ে আমরা সবাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাই। আমার বড় ভাই বিপ্লব ভারতে যায় এবং বাবা দেড় বছর এলাকার বাইরে পালিয়ে থেকে বাড়িতে ফিরে আসেন। আমার বড় ভাই ভারতেই থেকে গেছেন আর কোনদিন আসেননি। ভবিষ্যতে আসার ও ইচ্ছা নেই তার। ওই সময়ে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করার অপরাধে আমাদের পরিবারকে অনেক মাসুল দিতে হয়েছে। আমার তো এদেশের নাগরিক। তবুও আমাদের নিরাপত্তাহীনতা বাড়াতেই যেন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসে। অজানা ভয়ভীতি আমাদের তাড়া করে। বর্তমানে আমরা ভাল আছি। এখন যেমন আছি ভবিষ্যতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর যেন কোন নির্যাতন, নিপীড়ন না হতে পারে তার জন্য সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান ওই স্কুল শিক্ষক।

২০০১ সালের পহেলা অক্টোবরের নির্বাচনের পর বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর নির্যাতন নেমে আসে। যা ওই সময়ে দেশ বিদেশের বিভিন্ন গনমাধ্যমে প্রকাশ পায়। বাগেরহাটের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর জোট সরকারের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের এই হামলা চলেছে তাদের মতার পুরোটা সময় জুড়েই। কেউ প্রাণ হারান, কারও যায় সম্ভ্রম। কেউ টাকা খুইয়েছেন, কারো পুকুরের মাছ আর গোলার ধান লুট হয়ে যায়।

২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর অন্যতম আলোচিত ছিল মোরেলগঞ্জ উপজেলার চিংড়াখালির বাণিকান্ত মিস্ত্রী হত্যা ও সবিতা রাণী মন্ডলকে গণধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের সমর্থনে মিছিল করার অপরাধে বাণিকান্তকে জোট সন্ত্রাসীরা পিটিয়ে হত্যা করেছিল।

মোল্লাহাট উপজেলার গাওলা ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত গাওলা গ্রামের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তারাপদ পোদ্দারের বাড়িতে তৎকালিত সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জামায়াতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এর ক্যাডারদের সশস্ত্র হামলা, রামপালের ছবিরাণী নির্যাতন, যাত্রাপুরের কোমরপুরের ঠাকুরবাড়ি গণধর্ষণ, ডাকাতি ও হত্যাকান্ড এর কয়েকটা উদাহরণ মাত্র।

বাগেরহাট হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের হিসাব অনুযায়ী বাগেরহাট-১ আসনের ফকিরহাট, চিতলমারী ও মোল্লাহাট উপজেলায় মোট ভোটারের প্রায় ৩২ শতাংশ, বাগেরহাট-২ আসনের সদর ও কচুয়া উপজেলায় প্রায় ২৫ শতাংশ, বাগেরহাট-৩ আসনের রামপাল ও মংলা উপজেলায় প্রায় ২৮ শতাংশ এবং বাগেরহাট-৪ আসনের মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় ২০ শতাংশ ভোট রয়েছে। প্রতিপরে প্রচলিত ধারণা যে এই ভোটের উপর আওয়ামী লীগের একক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এই ভোট নিজেদের পে আনতে বিএনপিসহ সমমনাদের এই নির্যাতন মূলক কর্মকান্ড চলে প্রতিটি ভোটের আগে ও পরে।

হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের বাগেরহাট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মিলন কুমার ব্যানার্জী বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, বাগেরহাটের চারটি আসনে প্রায় ২২ শতাংশ ভোট সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। গত ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবরের নির্বাচনের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর অবর্নণীয় নির্যাতন চালানো হয়েছিল। ওই সময়ে বাগেরহাটের চারটি সংসদীয় এলাকায় খুন, হামলা, গনধর্ষণ, চাঁদাবাজির অসংখ্য ঘটনা ঘটে। এই এলাকার অনেক পরিবার ওই সময়ে জীবন বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে যায়। ২০০৮ সালের পর অনেকে এই দেশে ফিরেছেন আবার অনেকে ফেরেননি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে অজানা ভয়ভীতি ও আতংক বিরাজ করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরা তো এদেশেরই নাগরিক। তাদের ভোট দেয়ার অধিকার আছে। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রশাসনের সাথে আমাদের একাধিকবার মতবিনিময় সভা হয়েছে। তারা আমাদের নিরাপত্তা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আসন্ন নির্বাচনে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোট কেন্দ্রে যেতে পারে এবং ভোটের পরে যেন কোন সংখ্যালঘুর উপর নির্যাতন নেমে না আসে সেদিকে নজর রাখতে প্রশাসনের কাছে দাবি জানাচ্ছি।

বাগেরহাটের পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায় বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে জেলা পূজা উদযাপন ও হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের সাথে প্রশাসন একাধিক সভা করেছে। সংখ্যালঘুরা এদেশের নাগরিক। তাদের ভয় পাওয়ার কোন কারন নেই। তাদের প্রতি যদি কোন হুমকি ধামকি আসে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানানো আহবান জানান তিনি বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক ও জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা তপন কুমার বিশ্বাস বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, সংখ্যালঘুসহ কোন নাগরিককের উপর হুমকি আসলে প্রশাসন জিরো ট্রলারেন্সে অবস্থান করবে। তাই আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে কোন ধরণের বিশৃঙ্খলা অত্যাচার বা নির্যাতন সহ্য করা হবে না। অপরাধীদের সব ধরনের অপতৎপরতা কঠোর হাতে দমন করা হবে। এ জন্য প্রশাসনের সব ধরণের প্রস্তুতি রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত