যুদ্ধাপরাধ মামলায় তদন্ত শুরু হওয়ায় 

সুন্দরবনের দুবলার চরের রাজা খোকন আত্মগোপনে ! স্বস্তি ফিরেছে জেলে পল্লীতে 

মাসুদ রানা, মোংলা 

আপডেট : ০১:৩৬ পিএম, মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ | ৩২৭

খাঁন শফিউল্লাহ খোকন (৭৩) ওরফে রাজাকার খোকন। চার দশকে তিনি হয়ে ওঠেন সুন্দরবনের দুবলার চরের রাজা। প্রভাব আর আধিপত্য বিস্তার করে দূর্গম চরাঞ্চলে শাসন ও শোসন করেছেন নিরীহ জেলেদের। অর্থ, বৃত্তে ফুলে ফেঁফে ওঠেন লোক চক্ষুর আড়ালে। যে চরে এতোদিন দোদান্ড দাপটে রামরাজত্ব করেছেন, সেই জেলে পল্লী হতে হঠাৎ আত্মগোপন করেছেন তিনি। খবর ছড়িয়েছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে তদন্ত শুরু হলে পালিয়েছেন তিনি। রাজাকার খোকন খুলনার রুপসা থানার দেয়ারা এলাকার মৃত শহিদুল্লাহ খাঁনের ছেলে।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্র জীবনে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোনায়েম খাঁনের ন্যাশনাল ষ্টুডেন্ট ফ্রন্টের (এনএসএফ) সভাপতি ছিলেন খাঁন শফিউল্লাহ খোকন । এরপর ৭১ এর যুদ্ধের আগে ৬৮/৬৯ সালে খুলনায় খাঁন এ সবুরের লাঠিয়াল বাহিনীর দলে যোগ দেন। যুদ্ধকালীন সময়ে খুলনায় খাঁন আমজাদ হোসেন রাজাকার বাহিনীর সভাপতি হওয়ার পর তার দলে যোগ দেয় খোকন। পরে তাকে খুলনার রুপসা থানার দেয়ারা এলাকার রাজাকার বাহিনীর সভাপতি করেন খাঁন আমজাদ হোসেন। শুরু হয় খোকন রাজাকারের নারকীয় অত্যাতার-নির্যাতন। খোকন রাজাকারের দলে ২৫/৩০ জন সশস্ত্র সদস্য ছিলেন। ওই সময় এলাকার মুক্তিযোদ্ধা শামসুর রহমান ওরফে শ্যাম মল্লিককে গুলি করে হত্যা করেন তারা। এছাড়া তাদের হাতে আরও দুটি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খোকন দলবল নিয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। সেখানে দুই বছর আত্নগোপনে থাকার পর দেশে ফিরে আবারও খুন, ঘের, দখল ও টেন্ডারবাজির মতো সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে খুলনার বটিয়াঘাটা এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন।

দুবলার চরে রাজা হয়ে ওঠেন যেভাবে খোকন !

১৯৮৪ সালে প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মেজর জিয়া উদ্দিনের সাথে বঙ্গোপসাগরের দুবলার চরে শেকড় গড়তে শুরু করেন দূর্ধর্ষ খুনি খোকন রাজাকার। সেখানে শুরু করেন মাছের ব্যবসা। হয়ে যান কয়েক’শ কোটি টাকার মালিক। তবে নিজের চরিত্র পরিবর্তন করতে পারেনি। টাকার প্রভাবে হয়ে ওঠেন দোদান্ড প্রভাবশালী। দুবলার চরের নিরীহ জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের ভয় দেখাতে ২০০২ সালে খুলনার কুখ্যাত খুনী এরশাদ শিকারদার ও ক্রসফায়ারে নিহত আরেক খুনী লিটুকে ভাড়া করে নিয়ে যান সেখানে। মৌসুমে জেলেদের ওপর হামলা চালিয়ে মেহের আলীর চরে মাছের ব্যবসা দখলে নেয় খোকন। পরবর্তীতে দখলে নেয় আরেক চর আলোর কোল। সেখানে জেলেদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে ‘যখন যা খুশি’র মতো রীতি চালু করেন ভয়ংকর খোকন। মুহুর্তেই জেলেদের কাছে হয়ে ওঠেন মূর্তিমান আতংক। এভাবে চার দশক ধরে সুন্দরবন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের দুবলার চরে অঘোষিত মুকুটহীন সম্রাট হয়ে ওঠেন তিনি।

এরপর ২০১৭ সালে মুক্তিযোদ্ধ কমান্ডার ও দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান মেজর জিয়া উদ্দিনের মৃত্যুর পর পুরো ফিশারম্যান গ্রুপসহ দূর্গম দুবলার চরাঞ্চল দখলে নেয় সে। এতোদিনের দোদান্ড দাপটে চরাঞ্চালের সেই স্বঘোষিত শাসক হঠাৎ করে সপ্তাহ খানেক ধরে দুবলার চর থেকে আত্নগোপনে চলে যান।

দুবলার জেলে এবং ফিশারম্যান গ্রুপরে দেওয়া তথ্যমতে, যুদ্ধাপরাধ বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মুক্তিযোদ্ধা শামসুর রহমান ওরফে শ্যাম মল্লিককে হত্যার দায়ে খাঁন শফিউল্লাহ খোকন (৭৩) ওরফে রাজাকার খোকন সহ ৩ জনকে আসামি করে ২০২২ সালে মামলা করেন ছেলে সাইফুল মল্লিক গামা। ওই মামলায় এ বছরের গত ২৫ জানুয়ারী যুদ্ধাপরাধ বিশেষ ট্রাইব্যুনালের তদন্তকারী কর্মকর্তারা স্বরোজমিনে স্বাক্ষী গ্রহণ করেন।
মামলার সাইফুল মল্লিক গামা বলেন, মামলা দায়ের হওয়ার আগে ও পরে বিভিন্ন সময় শফিউল্লাহ খোকন এবং তার স্বজনরা হত্যা সহ মামলায় ফাসানোর নানা হুমকি দিচ্ছেন।

এ মামলার অন্যতম স্বাক্ষী আলহাজ মুনসুর আলী পোদ্দার বলেন, খান শফিউল্লাহ খোকন একজন রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। তার নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে রাজাকাররা শোলপুর দেয়ারা এলাকায় নারী ধর্ষণ, লুট ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। ১৯৭১ সালে রাজাকার কমান্ডার খান শফিউল্লাহ খোকন রুপসার যুগীহাটি গ্রামের শামসুর রহমান শামা মল্লিকসহ আরও কয়েকজনকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় শামা মল্লিকের পুত্র সাইফুল মল্লিক গামা যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন।

তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ক্ষমতাসীনদের উত্থান-পতন হলেও বেশ দাপটে ধরে রেখেছেন নিজের কর্তত্ব। আর চার দশক ধরে লোক চক্ষুর আড়ালে দুবলারচরে শুঁটকি মাছের ব্যবসায় প্রভাব বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন। তার নির্যাতনে অনেক ব্যবসায়ী ও সাধারণ জেলে দুবলারচর ছেড়ে চলে গেছে।

দুবলার চরে খোকন বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার মঠবাড়িয়া উপজেলার তুষখালী গ্রামের মামুন শরিফ ও মফিজুল শরিফ জানান, ওই বাহিনীর বেপরোয়া অত্যচার ও নির্যাতনে বিগত কয়েক দশকে সুন্দরবন ও সামুদ্রিক মাছের ব্যবসায় নি:স্ব হয়েছেন অসংখ্য পেশাজীবি। আবার অনেকে পুরোনো পেশা ছাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া দুবলার জেলে ও শুটকী ব্যবসায়ী গাজী রহমান, কেরামত মল্লিক ও বোরহান গাজী জানান, যুদ্ধাপরাধের তদন্তের খবর পেয়ে খান শফিউল্লাহ খোকন ওরফে খোকন রাজাকার দুবলারচর ছেড়ে গত সপ্তাহখানেক ধরে আত্মগোপনে রয়েছেন। আর এতে স্বত্বি ফিরেছে দুবলার জেলে পল্লীতে। আনন্দে মিস্টি বিতরন সহ খোকনের নানা অপকর্মের বিচার দাবিতে মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন।

এ প্রসঙ্গে দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহম্মেদ জানান, বিগত কয়েকদিন ধরে বহুলালোচিত দুবলার চরের মৎস্য ব্যবসায়ী খাঁন শফিউল্লাহ খোকন আত্নগোপনে রয়েছেন। এতে জেলে ও ব্যবসায়ীরা দুবলার চরাঞ্চলে মিষ্টি বিতরণ ও উল্লাসের খবর তিনি শুনেছেন।

এ প্রসঙ্গে, আত্নগোপনে থাকা খাঁন শফিউল্লাহ খোকন ওরফে রাজাকার খোকনের বক্তব্য জানতে তার ব্যবহৃত ০১৭১১-১৩০০৪৪ ও ০১৫১১-১৩০০৪৪ দুটি নম্বরে যোগাযোগ করা হলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এছাড়া এই দুই নম্বরে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত