জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের গৌরবময় ৩০ বছর পূর্তি

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের গৌরবময় অংশগ্রহণের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় জাতিসংঘ সদর দপ্তরে। জাতিসংঘ সদরদপ্তরে আয়োজিত উচ্চ পর্যায়ের এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অংশ নেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্ডোনিও গুতেরেজ, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি মিরো¯াভ লাইচ্যাক, ডিপার্টমেন্ট অব পিস কিপিং অপারেশন এর প্রধান আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ল্যাক্রুয়া, ডিপার্টমেন্ট অব ফিল্ড সাপোর্ট বিভাগের প্রধান আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল অতুল খারে, জাতিসংঘের মিলিটারি অ্যাডভাইজার লেফট্যানেন্ট জেনারেল কার্লোস হামবার্ট লয়টি এবং জাতিসংঘের পুলিশ অ্যাডভাইজর লুইস ক্যারিলহো।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্ডোনিও গুতেরেজ তাঁর বক্তৃতায় বলেন, “বাংলাদেশের ওপর কৃতজ্ঞ থাকার অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়ে এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় ও সুরাদানের মতো অবর্ণনীয় উদারতা প্রদর্শন। দ্বিতীয় কারণ হল শান্তিরা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিশ্রুতি”।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ অতি সম্প্রতি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে এবং এেেত্র উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু যদি পিসকিপিংয়ের কথা বলা হয়, তবে এত্রে শুরুতেই উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনে বিরাট সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ”।

জাতিসংঘ মহাসচিব শান্তিরা কার্যক্রমে বাংলাদেশের বিশাল সাফল্যের কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, “আমি আমার অফিস স্টাফদের বলেছিলাম, বাংলাদেশ পিসকিপিং-এ কতটা সফল তার কিছু ইন্ডিকেটর তৈরি করতে। সেটা তারা তৈরি করে আমাকে দিয়েছিল, কিন্তু সাফল্যের সেই ইন্ডিকেটরগুলো এত বেশী যে আমার পে মনে রাখা সম্ভব ছিল না। এতে প্রতীয়মান হয় বাংলাদেশ বৈশ্বিক শান্তিরা কার্যক্রমে কতটা সফল, কতটা গুরুত্বপূর্ণ”।

তিনি আরও বলেন, “এই মুহূর্তে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরী কার্যক্রমে দ্বিতীয় বৃহত্তম। শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের প্রায় ৭ হাজার নারী ও পুরুষ শান্তিরী কাজ করছে। সাইপ্রাসে ফোর্স কমান্ডার, মালি, দারফুর ও সাউথ সুদানে সেক্টর কমান্ডার এবং কঙ্গোতে বাংলাদেশের বিগ্রেড কমান্ডার রয়েছে। যা প্রমান করে শুধু সংখ্যার দিকেই নয় মানের দিক থেকেও বাংলাদেশ অতি উঁচু স্থান দখল করে আছে”।

জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের মহিলা আরমড পুলিশ ইউনিটের কার্যক্রমকে অসাধারণ বলে অভিহিত করেন। শান্তিরা কার্যক্রমে জাতিসংঘের কাছে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অব্যাহত অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতা না থাকলে আমাদের পে শান্তিরায় এ ধরনের সার্পোট দেয়া সম্ভব হতো না”।

জাতিসংঘ মহাসচিব বৈশ্বিক শান্তিরায় কর্তব্যরত অবস্থায় জীবনদানকারী বাংলাদেশী শান্তিরীদের গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন এবং তাঁদের অসামান্য আতœত্যাগের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করেন।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি মিরো¯াভ লাইচ্যাক শান্তিরা কার্যক্রমে যৌন নিগ্রহ ও যৌন অপব্যবহারের েেত্র বাংলাদেশের শূন্য রেকর্ড উল্লেখ করে বলেন, “এটি বিশ্বের বুকে একটি উদাহরণ তৈরি করেছে”।

তিনি আরও বলেন, “বিশ্বের ৪০টি দেশে ৫৪টি পিস কিপিং মিশনে সফলতার সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা সত্যিই বিস্ময়কর। বিগত ত্রিশ বছর ধরে বাংলাদেশ অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে জাতিসংঘ শান্তিরা কার্যক্রমে তাদের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে”।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত তাঁর বক্তৃতায় বলেন, বর্তমান সরকার বাংলাদেশের শান্তিরীদের জন্য টেকসই বিনিয়োগ করছে। সীমিত স¤পদের মধ্যেও সরকার শান্তি রীদের প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি সরবরাহ করছে। অর্থমন্ত্রী জাতিসংঘ মহাসচিবের শান্তি রা কর্মসূচীরসকার্যকর ফলাফল পেতে পর্যাপ্ত আর্থিক সরবরাহের কথা উল্লেখ করেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, “আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রায় বাংলাদেশ সব সময়ই পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করে যাবে মর্মে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আমাদের শান্তিরীগণ তা পালন করে চলেছেন। বাংলাদেশের ১৪২ জন বীর শান্তিরী তাদের সর্বোচ্চ আতœত্যাগের মাধ্যমে জাতির পিতার সেই প্রতিশ্রুতিরই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন”।

তিনি আরও বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের শান্তিরীদের নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে বদ্ধ পরিকর। আমাদের নারী পুলিশ শান্তিরীগণ জাতিসংঘের সকল নারী কন্টিনজেন্টের মধ্যে সেরা। ২০২০ সালের মধ্যে আমরা মিলিটারি কন্টিনজেন্টে নারী শান্তিরী প্রেরণের পরিকল্পনা করছি”।

জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন জাতিসংঘ শান্তিরা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অব্যাহত সমর্থন ও অংশগ্রহণের কথা পূণর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, জাতিসংঘের নীল হেলমেটের অধীনে বিশ্ব শান্তিরায় ভূমিকা রাখতে পেরে বাংলাদেশ গর্বিত। রাষ্ট্রদূত আমাদের সাম্প্রতিক এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের সাফল্যের কথা উল্লেখ করেন। রাষ্ট্রদূত মাসুদ নিরাপত্তা পরিষদের আসন্ন বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
.

ত্রিশ বছর পূর্তি উপলে অনুষ্ঠানে একটি কেক কাটা হয়। অনুষ্ঠানস্থলের চারিদিকের দেওয়াল সুসজ্জিত করা হয় বাংলাদেশ উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ও জাতিসংঘ শান্তিরী মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরীদের অবদান ও সাফল্যগাঁথার অসংখ্য আলোকচিত্র দ্বারা।

অনুষ্ঠানটিতে জাতিসংঘ শান্তিরা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বিভিন্ন অর্জন ও কর্মকান্ডের উপর একটি ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। কর্তব্যরত অবস্থায় আতœদানকারী বাংলাদেশী শান্তিরীদের প্রতি সম্মান জানিয়ে একমিনিট নিরবতা পালন করা হয়।

প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স¤পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা: দীপু মনি এমপি, বাংলাদেশের এসডিজি কো-অর্ডিনেটর আবুল কালাম আজাদ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন নিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফট্যানেন্ট জেনারেল মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান; সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী এবং বাংলাদেশ পুলিশের উর্দ্বতন কর্মকর্তা, স্থায়ী মিশন, নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল ও জাতিসংঘে কর্মরত বাংলাদেশ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাগণসহ বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এ কে এ মোমেন, নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল শামীম আহসানসহ ঊর্ধ্বতন
কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

এছাড়াও ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সামাদ আজাদ ও নিউইয়র্ক প্রবাসী বিশিষ্ট বাংলাদেশী নাগরিকগণ এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ডেলিগেট ডাইনিং হলে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানটির প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওভারসীস অপারেশন পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী শামসুল ইসলাম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালন ও পরিচালনা করেন জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের ডিফেন্স অ্যাডভাইজর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খান ফিরোজ আহমেদ ও তাঁর কন্যা ফাবিহা তাহসিন।