বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পূজা

কবরী বিশ্বাস অপু

আপডেট : ০৬:০৯ পিএম, মঙ্গলবার, ৫ অক্টোবর ২০২১ | ১৫২৯

"আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির, ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগতমাতার আগমন বার্তা"


বাংলাদেশের প্রকৃতির সাথে উৎসব উদযাপনের সুনিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।তেমনি শারদ প্রকৃতির অন্তরাকাশে জ্যোতির্ময়ী দেবী দুর্গার আগমনের এক নিবিড় সম্পর্ক লক্ষনীয়।শারদীয় এই দুর্গোৎসব তারই অনন্য উদাহরণ।বারো মাসে তেরো পার্বণের এই দেশে প্রতিটি ঋতুই আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল।ঋতুর এই নান্দনিক পালাবদল আর বৈচিত্র্যময়তাই ধরা দেয় উৎসবের প্রতীক হিসেবে।আলাদা করে আর মনে রাখতে হয়না উৎসবের হিসাব।যুগেযুগে ঋতুর এই বর্ণিল রূপ-বৈচিত্র্যই উৎসব-আনন্দের সূচনা করে যায় মানব মনে।



শুভ্র-সুনীল নীল আকাশ,সাদা মেঘের কারুকাজ আর দিগন্ত বিস্তৃত কাশফুলের তুলতুলে-স্পন্দিত ক্যানভাস- এ যেন শৈল্পিক শরতের সুনিপুন প্রতিচ্ছবি।নান্দনিক শরতের আদুরে ভোরে শিশির সিক্ত শিউলি মনে করিয়ে দেয় দেবী আগমনের কথা'ই।হিম হিম আশ্বিনের সদ্য প্রস্ফুটিত পদ্মফুলের বুকের ভেতর ভ্রমরের গুঞ্জন গুনগুন করে গেয়ে যায় দশভুজার আগমনী গান।এমনই এক ছবির মত সজল ভোরে মহালয়া এসে উৎসবের সূচনা সঙ্গীত রচনা করে যায় যুগেযুগে।দেবীকে বরণ করে নেওয়ার অপেক্ষা যেন ফুরোতেই চায়না।চোখের সামনে এক পশলা বৃষ্টির মত জ্বলজ্বল করে ওঠে সর্বজনীন উৎসবের অলিখিত চিত্র।



মহালয়ার দিন থেকে দেবী পক্ষের আরম্ভ।আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পাঁচদিন দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়।যথাক্রমে ষষ্ঠী,মহাসপ্তমী,মহাষ্টমী,মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত।শারদীয় এই দুর্গোৎসব 'অকাল বোধন' নামেও পরিচিত।দুর্গাপূজা পাঁচদিনের হলেও মহালয়া থেকে শুরু করে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার মাধ্যমে তা শেষ হয়।সেই সাথে শেষ হয় দেবীপক্ষেরও।ফুল,চন্দন,বেলপাতা,দীপের আলো,ধুপের ধোয়া,উলুধ্বনি,স্তব-স্তুতি ও বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি সবমিলিয়ে এক পবিত্র আবহের সৃষ্টি হয় মন্দিরে মন্দিরে।




স্নিগ্ধ শরতের সকালে হিম হিম হাওয়া মনকে অন্যরকম এক প্রশান্তির সাগরে নিমজ্জিত করে তোলে।চারিদিক থেকে বাতাসে ভেসে আসে পূজো পূজো গন্ধ।শপিং মল আর পোশাকের দোকানগুলোতে জমে ওঠে পূজার কেনাকাটা।ব্যস্ত সময় পার করেন ক্রেতা-বিক্রেতারা।ছোটদের মধ্যে উৎসবের এই আমেজ বেশি লক্ষ্য করা যায়।পূজার পুরোটা সময় জুড়েই ঘরে ঘরে চলে নারকেল নাড়ু-লুচি তৈরির মহোৎসব।বন্তুত বাংলাদেশের উৎসব মানেই আনন্দ।


আধুনিক জীবন এখন ভার্চুয়াল ফ্রেমে অনেকখানি বন্দি।ফেসবুকীয় সংস্কৃতি তাতে এনে দিয়েছে অন্যমাত্রা।পূজা শুরুর এক মাস আগে থেকেই শাড়ি,পাঞ্জাবি আর গহনার পেইজগুলোতে শুরু হয় বেচাকেনার তোড়জোড়।বলা চলে এখন অনলাইনে কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়।সেইসাথে শুরু হয় শারদীয় ফটোশুট।তাতে দেখা যায় রাশি রাশি লাইক,কমেন্ট আর রিয়্যাক্টের সমাহার।


সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা।নানান পরিবর্তন,পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে সময়।প্রতিমা নির্মাণেও এসেছে পরিবর্তন।কখনও সনাতনী প্রথা,আবার কখনও প্রথাসিদ্ধ রীতিনীতির বাইরে এসেও সময় ও প্রকৃতিকে উপজীব্য করে নির্মাণ হচ্ছে প্রতিমা।শিল্পীর ক্যানভাস থেকে ভাস্করের ভাবনায় এসেছে অামূল পরিবর্তন।সাজসজ্জা থেকে শুরু করে প্রতিমা স্থাপনেও এসেছে নান্দনিকতা।থিম অপরিবর্তিত রেখে প্রতিমার আদলে এসেছে বৈচিত্র্য।গেল বছর করোনা মহামারীকে উপজীব্য করে কোথাও কোথাও নির্মিত হয়েছিল দেবী দুর্গার প্রতিমা।কোথাও কোথাও প্রতিমা তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে মানুষের আদল।সবমিলিয়ে নান্দনিকার এক অপরূপ বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায় প্রতিমাগুলোতে।



ঋতুবদলে,পূজা-পার্বণে প্রকৃতি যেমন আপন রূপে স্বমহিমায় সেজে ওঠে।তেমনি মানব মনেও বিরাজ করে উৎফুল্লতা।ভক্তি-প্রেম-আরতিতে মন হয়ে ওঠে প্রফুল্ল।আমার কাছে বাংলাদেশের উৎসব মানে আনন্দ,উৎসব মানে সম্প্রীতি,উৎসব মানে সমৃদ্ধি।শারদীয় দুর্গোৎসব অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।বাংলাদেশের উৎসব মানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে একটা প্লাটফর্মে নিয়ে আসা।তবুও কোথাও কোথাও প্রতিমা ভাংচুরের মত নিকৃষ্ট ঘটনা মনকে ব্যথিত করে তোলে।প্রত্যাশা করি দুর্গতিনাশিনী সকল অপশক্তির বিনাশ করবেন।করোনা মহামারী মুক্ত পৃথিবী ফিরে আসুক আবার।অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠুক।শারদীয় শুভেচ্ছা সবাইকে এবং কবির উচ্চারণে-


“বাংলার মাটি, বাংলার জল,

বাংলার বায়ু, বাংলার ফল

পুণ্য হউক পুণ্য হউক

পুণ্য হউক হে ভগবান।"

লেখক

কবরী বিশ্বাস অপু

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত