অযত্ন অবহেলায় বাগেরহাটের বধ্যভূমি ও স্মৃতিস্তম্ভ

শেখ আহসানুল করিম

আপডেট : ০৪:২৫ পিএম, বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ | ১০৭০

বাগেরহাটে মহান মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী হিসেবে চি‎ি‎হ্নত বধ্যভূমি ও স্মৃতিস্তম্ভগুলো সারা বছর অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকে যা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিক ও শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোন দিবস আসলেই শুধু ওই বধ্যভূমি, স্মৃতিস্তম্ভগুলো ধুঁয়েমুছে তাতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। দিবসের কয়েকদিন যেতে না যেতেই তা আমরা ভুলে যাই। যা আগামী প্রজন্মের জন্য খুবই দুঃখজনক বলে মনে করেন ওই যোদ্ধারা। তাই বাগেরহাটের এই বধ্যভূমি ও শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভগুলো সংরক্ষণ করার দাবি জানান তারা।

৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদারদের দোসর রজ্জব আলী ফকিরের রাজাকার বাহিনী সবচেয়ে বড় গণহত্যাটি চালায় বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার পেড়িখালী ইউনিয়নের ডাকরা গ্রামে। ১৯৭১ সালের ২১ মে পুরো ডাকরা গ্রামকে রাজাকাররা বধ্যভূমি করে তুলেছিলো। গুলি ও জবাই করে তারা সেদিন দুই শতাধিক সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। এছাড়া কচুয়া উপজেলার শাাঁখারীকাঠি, মঘিয়া ও কচুয়া সদরে, বাগেরহাট শহরের ডাকবাংলো ঘাট ও সদর উপজেলার কান্দাপাড়ায় নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের গুলি ও জবাই করে হত্যা করে রাজাকাররা।

স্বাধীনতার পর এসব স্থান চি‎িহ্নত করে স্থানীয় প্রশাসন বধ্যভূমি ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করে। এরমধ্যে ১৯৯৭ সালে বাগেরহাট শহরের ভৈরব নদের তীরের ডাকবাংলো বধ্যভূমি হিসেবে চি‎ি‎হ্নত করে একটি ফলক উন্মোচন করা হয়। কিন্তু ওই ফলক উন্মোচনের ২০ বছর পার হলেও সেই জায়গাটি উন্মুক্ত পড়ে আছে। যা আজও সংরক্ষণ করা হয়নি। এছাড়া মোরেলগঞ্জ উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের একটি বধ্যভূমি হিসেবে চি‎ি‎হ্নত করা হয়নি। আর অন্য যেগুলো রয়েছে তা সারাবছরই পড়ে থাকে অযতœ ও অবহেলায়। ময়লা আবর্জনার স্তুপ হয়ে পড়ে থাকে। কোথাও কোথাও আগাছা গজিয়ে উঠেছে। কোন দিবস আসলেই সেগুলো ধুুঁয়ে মুছে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে তাতে ফুল দিয়ে শহীদদের স্মরণ করা হয়।

রনাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধা মানিক লাল মজুমদার ক্ষোভ প্রকাশ করে বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, পাক হানাদারদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে সেদিন বাগেরহাটের মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাসহ বাগেরহাটের অসংখ্য মানুষ রাজাকারদের হাতে খুন হন। তাদের আতœত্যাগের জন্য আজ আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে সরকার বধ্যভূমিগুলো চি‎ি‎হ্নত করে সেখানে স্তম্ভ নির্মান করে তা সংরক্ষণ করেছে। কিন্তু সেইসব স্থানগুলো বলতে গেলে সারা বছরই পড়ে থাকে অযতœ অবহেলায়। যাদের আতœত্যাগে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি তাদের স্মৃতিস্তম্ভগুলো সারা বছর যাতে যতেœ রাখা যায় তার ব্যবস্থা করতে প্রশাসনের কাছে দাবি জানান ওই মুক্তিযোদ্ধা।

বাগেরহাট সরকারী পিসি কলেজের ছাত্র আলী রেজা আহম্মেদ বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, বাগেরহাটের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বইতে পড়েছি। ওই সময়ে রাজাকাররা যেসব স্থানে নরহত্যা চালিয়েছিল সেসব জায়গা ঘুরে দেখতে গিয়ে দেখি তা অরক্ষিত হয়ে পড়ে আছে। অধিকাংশ স্থানে সীমানা প্রাচীর নেই, খোলা পড়ে আছে। আর যেগুলোতে সীমানা প্রাচীর আছে তার উপরে ময়লা আবর্জনার স্তুপ হয়ে আছে। এগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব প্রশাসনসহ আমাদের সকলের। তাই আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির বাগেরহাট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ফররুখ হাসান জুয়েল বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাগেরহাট শহরের ভৈরব নদের তীরের ডাকবাংলোর বধ্যভূমিটি অন্যতম কসাইখানা হিসেবে পরিচিত। রাজাকাররা এখানে অসংখ্য মানুষকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করে তার মরদেহ ভৈরব নদে ভাসিয়ে দেয়। ১৯৯৭ সালে স্থানীয় প্রশাসন এখানে একটি ভিত্তিফলক উন্মোচন করে। কিন্তু ওই ফলক উন্মোচনের ২০ বছর পার হলেও সেই জায়গাটি এখনো উন্মুক্ত পড়ে আছে। যা আজও সংরক্ষণ করা হয়নি। আগামী প্রজন্মের তরুণদের জন্য এই স্থানে অবিলম্বে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মান করার দাবি জানান ওই নেতা।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বাগেরহাট জেলা কমান্ডার শাহীনুল আলম ছানা বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, ১৯৭১ সালে রাজাকাররা বাগেরহাটে অন্তত সাতশ মানুষকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করে। বাগেরহাটের প্রায় সব বধ্যভূমি ও স্মৃতিস্তম্ভগুলো সারা বছর অযতেœ অবহেলায় পড়ে থাকে। কোন দিবস আসলেই সেগুলো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে তাতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। তাই এই স্মৃতিস্তম্ভগুলোতে সীমানা প্রাচীর দিয়ে তা সংরক্ষিত করা এবং শহরের ডাকবাংলোর বধ্যভূমিটিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করে তা সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন ওই সংগঠক।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, বাগেরহাটে শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত বধ্যভূমি ও স্মৃতিস্তম্ভগুলো সংরক্ষিতই রয়েছে। সরকার এই বধ্যভূমিগুলো রক্ষার জন্য বরাদ্ধ দিচ্ছে। এগুলোকে আরও ভালভাবে রাখতে প্রশাসন উদ্যোগ নেবে। তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে বাগেরহাটের কেন্দ্রীয় বধ্যভূমি হিসেবে চি‎ি‎হ্নত ডাকবাংলোকে পূর্ণাঙ্গ রুপ দিতে খুব শিগগির কাজ শুরু করা হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি। এছাড়া জেলার সবগুলো বধ্যভূমি সারাবছর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের পাশাপাশি সবাইকে আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত